No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলার অতুলনীয় কৃষ্টি টেরাকোটার হাতি-ঘোড়ার নেপথ্য কথা

    বাংলার অতুলনীয় কৃষ্টি টেরাকোটার হাতি-ঘোড়ার নেপথ্য কথা

    Story image

    বাংলার সঙ্গে পোড়ামাটির শিল্পকর্মের বহু প্রাচীন সম্পর্ক। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিকাশকাল থেকেই বিপুল পরিমাণে পোড়ামাটির ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পোড়ামাটি বা টেরাকোটা শিল্পের জন্য সবথেকে খ্যাতি লাভ করেছে বাঁকুড়া জেলা। যে বিখ্যাত টেরাকোটার ঘোড়া এক সময় ভারতীয় হস্তশিল্পের জাতীয় প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার জন্ম হয়েছিল এই বাঁকুড়ারই প্রত্যন্ত গ্রাম পাঁচমুড়ায়।

    বাঁকুড়ার খাতড়া সাব ডিভিশনের তালড্যাংরা পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত পাঁচমুড়া নামের এক ছোট্ট গ্রাম; বিষ্ণুপুর শহর থেকে যার দূরত্ব ২০-২২ কিলোমিটার। বাঁকুড়ার টেরাকোটা ঘোড়া বলতে আমাদের চোখে সাধারণত যে ছবি ভেসে আসে, তা আদতে সুরুচিপূর্ণ ভঙ্গীতে দাঁড়ানো এই পাঁচমুড়ার টেরাকোটা ঘোড়া-ই। প্রাথমিকভাবে গ্রামের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করবার জন্য এর নির্মাণ হলেও বর্তমানে ভারতীয় লোকশিল্পের নিদর্শন হিসেবে এই ঘোড়া বিশ্বমানের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এক সময় ‘অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্র্যাফটস’-এর লোগোতে বাঁকুড়ার ঘোড়ার ছবি ব্যবহৃত হত।

    বাঁকুড়া ঘোড়াগুলির ভেতরের অংশ সম্পূর্ণ ফাঁপা। ঘোড়াগুলির দেহের বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদাভাবে কুমোরের চাকায় নির্মিত হয়। তারপর নরম মাটি ব্যবহার করে অংশগুলিকে জুড়ে দেওয়া হয় যথাস্থানে। কাঁচামাটি দিয়ে নির্মিত হয় পাতার আকৃতির কান ও লেজ। নির্মাণকাজ শেষ হলে বন্ধ ঘরে ছয় থেকে সাত দিন শুকানো হয় পুতুলগুলি। তারপর শুকানো হয় রোদে। সবশেষে আগুনে পুড়ে ঘোড়াগুলি তাদের চিরাচরিত চেহারা পায়। কি অসামান্য দৃপ্ততার সঙ্গে গ্রীবা উঁচিয়ে থাকে সে ঘোড়া!

    প্রাথমিকভাবে গ্রামের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করবার জন্য এর নির্মাণ হলেও বর্তমানে ভারতীয় লোকশিল্পের নিদর্শন হিসেবে এই ঘোড়া বিশ্বমানের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এক সময় ‘অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্র্যাফটস’-এর লোগোতে বাঁকুড়ার ঘোড়ার ছবি ব্যবহৃত হত।

    অনেক সময়েই বিভিন্ন গ্রামীন দেবদেবীর কাছে ঘোড়া মানত করে থাকেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। তবে রাঢ় অঙ্গলের স্থানীয় লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজায় আসল ঘোড়ার বদলে ব্যবহার হয় পোড়ামাটির ঘোড়া। আজও বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে গেলে অনেক সময় চোখে পড়ে বিশালাকার পিপুল অথবা অশ্বথ গাছের নিচে নানান উচ্চতার টেরাকোটার ঘোড়া সার দিয়ে  দাঁড় করানো রয়েছে। একসময় মনোস্কামনা পূরণে তৈরি হতো থানের ঘোড়া। বিগত তিরিশ বছরে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে এই থানের ঘোড়ারই এক বিরল রূপান্তর ঘটেছে। থানের ঘোড়াই তার ভোল পালটে হয়ে গেছে ঘর সাজানোর কথাকলি ঘোড়া।  ‘কথা’ শব্দের অৰ্থ কাহিনি ও ‘কলি’ শব্দের অৰ্থ অভিনয়। বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের এই টেরাকোটার ঘোড়াগুলির রূপের সারল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জটিল অলঙ্কারের সুষমা। এই সুষমা লোকশিল্পের নমুনা। ফলে বলতে হয় দৈনন্দিন গ্রাম জীবনে যা ছিল মনোস্কামনা পূরণের বাহন, তা এখন রূপান্তরিত হল কারুশিল্পে।

    এছাড়াও এখানকার অন্যতম বিখ্যাত শিল্পকর্মটি হল টেরাকোটার বোঙা হাতি। ছোটোখাটো গোলগাল চেহারার এই হাতির গায়ে দেখা যায় বহুমুল্য অলংকারের মোটিফ। এক সময়ে মল্ল রাজাদের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুর, যে কারণে বিষ্ণুপুর শহর ও এ সংলগ্ন কিছুটা অঞ্চল ‘মল্লভূম’ নামে পরিচিত। কেবলমাত্র পরিবহনের উদ্দেশ্যে নয়; পরাক্রম জাহির করতেও এখানকার রাজাদের হাতিশাল-ঘোড়াশালে রাখা থাকত অসংখ্য হাতি-ঘোড়া। কারুকার্যে পরিপূর্ণ অলংকার দিয়ে তাদের সাজানো হত সময়ে সময়ে। টেরাকোটার হাতি ঘোড়া তৈরির ক্ষেত্রে ঠিক এই বিষয়টিই মনে রাখেন পাঁচমুড়ার কারিগরেরা।

    বাস্তবের সঙ্গে সাযুজ্য রাখার চাইতে কয়েক ধাপ এগিয়ে, শুঁড় ও শরীরের আশ্চর্য সামঞ্জস্যের কারণে বোঙা হাতি যেন বিমূর্ততার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শোনা যায়, মল্লভূমে বসবাসকারী সাঁওতাল উপজাতির মানুষ এই টেরাকোটার হাতি বানিয়ে তা উৎসর্গ করেছিল তাদের উপাস্য দেবতা সিং বোঙার কাছে। আর তা থেকেই এই হাতির এমন নাম।

    পোড়ামাটির মূর্তি বা পুতুল তৈরিতে ব্যবহার হয় বিশুদ্ধ এঁটেল মাটি। মাটি প্রায় তিন-চার ফুট গভীরতা অবধি খুঁড়লে তবেই এর নাগাল পাওয়া যায়। আর যে কারিগর নিজহাতে মূর্তি নির্মাণ করেন, কেবল তিনিই এই মাটির সঠিক যাচাই করতে পারেন। অনেক সময়েই এঁটেল মাটির খোঁজে পাঁচমুড়া থেকে বেশ খানিক দূর অবধি যেতে হয় শিল্পীদের। এছাড়াও, মূর্তিগুলির উপরের প্রলেপ দিতে প্রয়োজন পড়ে এক বিশেষ ধরনের নরম মাটির, যা বহু দূরের নদী থেকে শিল্পীদের সংগ্রহ করতে হয়।

    পাঁচমুড়া ছাড়াও রাজগ্রাম, সোনামুখি, হামিরপুর এমন কয়েকটি জায়গাতেও পোড়ামাটির শিল্পকর্মগুলি তৈরি হয়। সোনামুখিতে তৈরি হাতি ঘোড়াগুলি যেন অঙ্গসৌষ্ঠবে পাঁচমুড়ার হাতি ঘোড়াগুলির চাইতে অনেকখানি ম্লান। এদের চেহারা অনাড়ম্বর, পাঁচমুড়ার পুতুলগুলির মতো অলংকারের আতিশয্য নেই তাতে। স্থানীয় ধাঁচ ও শৈলী এগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেয়। অঞ্চলভেদে কারিগরেরা তাঁদের পুতুলগুলির ধাঁচে সামগ্রিক বদল না এনে এক-একটি অংশ চিরাচরিত পদ্ধতিতে তৈরি করেন। এ থেকেই পরবর্তীকালে বুঝতে পারা যায় যে সেই বিশেষ মূর্তিটির উৎস কোথায়।

    তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল এসেছে টেরাকোটার হাতি ঘোড়া নির্মাণের কায়দাতেও। বাস্তব প্রতিমূর্তি থেকে অনেকাংশে প্রতীকী প্রতিমূর্তিতে উন্নীত হয়েছে পুতুলগুলি। কিছুক্ষেত্রে ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছে আধুনিক মোটিফেরও। হাতি, ঘোড়ার পাশাপাশি টেরাকোটা শিল্পীরা তৈরি করেন পোড়ামাটির বাইসন, বাঘ, কিংবা নানান দেবদেবীর মূর্তি। এ সমস্ত হস্তশিল্পগুলিকে ঘরে রাখলে, ঘরের শোভা যেন মুহূর্তে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। অথচ, টেরাকোটার মূর্তি বা পুতুল কারিগরদের নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বছরের বিশেষ কয়েকটি সময়ে পুতুলগুলি বিক্রি হলেও, অন্য সময়গুলিতে মন্দা থাকে। 

    তবে, পরিবেশগত ভাবে সমস্যা যত বাড়ছে, প্রকৃতির কাছাকাছি, মাটির কাছাকাছি থাকার গুরুত্ব ও প্রবণতা বাড়ছে। সেদিক থেকে দেখলে, টেরাকোটার মূর্তি বা পুতুল সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। যাঁরা শিল্পী-কারিগরদের থেকে সরাসরি সংগ্রহ করতে পারবেন না, শহরের বহু ছোটো-বড়ো বিপণিতে টেরাকোটার পুতুল পাওয়া যায়, সুবিধে মতো সংগ্রহ করে নিতে পারেন। ঢুঁ মারতে পারেন ১২৭, যোধপুর পার্কের দ্য বেঙ্গল স্টোর-এ। বাংলার কারুশিল্পের সংগ্রহশালা বলা যায় এই বিপণিকে। পাওয়া যায় হাতি-ঘোড়া সহ নানা ধরনের অভিনব টেরাকোটার পুতুল।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @