No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    পঞ্চকোটের রাজকন্যে আর ভাদু গানের আশ্চর্য ইতিহাস

    পঞ্চকোটের রাজকন্যে আর ভাদু গানের আশ্চর্য ইতিহাস

    Story image

    ঢেউ খেলানো লালমাটির দেশ। অযোধ্যা পাহাড় ঘিরে রয়েছে তার একদিক। সেখানে জঙ্গল, বামনি, তুর্গা নদী, হাতির পাল, হরিণ, বাঘ। এরই মাঝে সমতলভূমি। বয়ে গেছে কাঁসাই। তার দু’পাশের পলিভরা মাটিকে সবুজ করে তুলেছে মানুষ। এই লালমাটি, পাহাড় আর সবুজ ফসলের দেশ পুরুলিয়ায় ভেসে ভেসে বেড়ায় ভাদু গান। বাংলার শিকড়ে লেপ্টে থাকা এই লোকগানের জন্মের সঙ্গে মিশে রয়েছে ইতিহাস আর কিংবদন্তির অপরূপকথারা। 

    ভাদুর আড়ালে এক রাজকুমারীর করুণ গল্প। রাজকন্যে ভদ্রাবতী। ভদ্রাবতীর এই কাহিনিও অবশ্য একরৈখিক নয়। তাতে নানা রং, পাঠান্তর। লোককাহিনির শর্তই হল, তা তৈরি হয় লোকমুখে। এক মুখ থেকে অন্য মুখে বদলাতে থাকে নদীর স্রোতে বয়ে যাওয়ার মতো। এখানেও তাই ঘটেছে। কিন্তু, এই কাহিনিকে একেবারে গল্পকথা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে ঐতিহাসিক সময়, ঐতিহাসিক চরিত্ররা। ভাদুর জন্ম তাই কল্পনা আর ইতিহাসে মেশা।

    আজ থেকে প্রায় পৌনে দুশো বছর আগের কথা। তখন পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজা ছিলেন নীলমণি সিংদেও। এক সূত্র বলে, এই নীলমণি সিংদেওর তৃতীয় কন্যা নাকি ভদ্রাবতী। যদিও, ইতিহাস এই তথ্য নিয়ে সন্দিহান। রাজা নীলমণির তিন রানির গর্ভে দশটি পুত্রসন্তান হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কন্যাসন্তানের প্রমাণ তো মেলে না। সে যাহোক, এই ভদ্রাবতী রাজার বড়ো প্রিয়। তার বিবাহ স্থির। কিন্তু, বিয়ে করতে আসার পথে হবু স্বামী আর বরযাত্রীরা সবাই প্রাণ দিলেন ডাকাতদের হাতে। সেই বিরহ সহ্য করতে না পেরে ভদ্রাবতীও চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন দিল। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, পুরুলিয়া’ বইতে এই তথ্যই রয়েছে। ভদ্রাবতীর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রেমের আকুতিকে স্মরণীয় করে রাখতে নীলমণি সিংদেওই নাকি প্রচলন করেন ভাদু গান।

    এইখানে এসে একটা ধাঁধাঁ জোরালো হয়। ভাদু তো লোকগান। অথচ, তার প্রতিষ্ঠা হল কিনা রাজপরিবারের হাত ধরে। বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। কারণ ইতিহাস বলছে, পঞ্চকোট রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় সত্যিই গাওয়া হত ভাদু গান। কিন্তু, সেই ভাদুতে লোকশিকড়ের ছাপ নেই। বরং হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ, তবলা, সানাই সহযোগে সে এক উচ্চাঙ্গ মার্গসঙ্গীতেরই ঘরানা যেন। যে ঘরানার প্রতিষ্ঠাতারা সবাই রাজপরিবারের মানুষ-- ধ্রুবেশ্বরলাল সিংদেও, প্রকৃতীশ্বরলাল সিংদেও এবং রাজেন্দ্রনারায়ণ সিংদেও। 

    অথচ, ভাদু আদতে লোকজীবনের সঙ্গে লেপ্টে থাকা মেয়েদের গান। শুধু তাই নয়, ভাদু আসলে লোকউৎসবও। যে গান, যে উৎসবের গড়ন, রীতি ঐ রাজপরিবারের দরবার ছাড়িয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। এ কেমন করে সম্ভব? ভদ্রাবতীকে নিয়ে আরেকটি গল্পে হয়তো রয়েছে এর ইঙ্গিত। সেই গল্পে ভদ্রাবতী রাজার ঔরসজাত রাজকন্যে নয়।

    লাড়া গ্রামের মোড়ল এক ভাদ্রমাসে ধানখেতের আলের পাশ থেকে কুড়িয়ে পেলেন ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানকে। তাকে কোলে নিয়েই মোড়ল বুঝলেন, শিশুটি সদ্যোজাত। কে জানে, হয়তো এই উর্বরা ভূমিই জন্ম দিয়েছে তার। যেভাবে ভূমি জন্ম দিয়েছিল সীতারও। মোড়ল শিশুটিকে নিয়ে এলেন ঘরে। সেই ভাদ্র ছিল রোদে পোড়া, খটখটে। কিন্তু, এই মেয়ে ঘরে আসতেই বৃষ্টি এল ঝেঁপে। ধান হল খুব। সবাই বললে, এ মেয়ে ভারী লক্ষ্মীমন্ত। মোড়ল-দম্পতি মেয়ের নাম দিলেন ভদ্রাবতী। ডাকনাম ভাদু। ভাদুর রূপ হল খুব। চাষির ঘরে এমন রূপ মানায় না। রাজা নীলমণি সিংদেওর কানেও গেল ভাদুর কথা। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদকে রাজা বললেন, ওই মেয়েকে তিনি দত্তক নেবেন। রাজপরিবারই ওর যোগ্য স্থান। কিন্তু, ভাদু কিছুতেই যেতে চাইল না বাবা-মাকে ছেড়ে। তখন রাজা গ্রামে-গ্রামে ঢেঁড়া পিটিয়ে বলে দিলেন, রাজপ্রাসাদে না থাকলেও ভদ্রাবতী রাজকন্যেই।

    ভাদু তখন ষোড়শী। তার কানে উজিয়ে আসে বাঁশির সুর। গ্রামের কবিরাজের ছেলে অঞ্জন সেই বংশীবাদক। মন দেওয়া-নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে, হইহই করে পঞ্চকোটেও এসে পড়ে ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহে মদত দেওয়ার অভিযোগে ইংরেজদের হাতে বন্দি হন রাজা নীলমণি সিংদেও। রাজা বন্দি, এদিকে রাজকন্যে প্রেমে পড়েছে কবিরাজপুত্রর। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। রাজা মুক্তি পেতেই সে জানায় সবটা। ক্রুদ্ধ রাজা বন্দি করেন অঞ্জনকে। 

    অঞ্জনের কয়েদের খবরে ছুটে আসে ভদ্রাবতী। তার করুণ আকুতিতেও মন গলে না রাজার। তখন ভাদু, দিনের পর দিন হৃদয় নিঙড়ানো করুণ গান গেয়ে ঘুরতে থাকে কয়েদখানার চারপাশে। সেই গানে একদিন মন গলল রাজার। অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন তিনি। কিন্তু, ভাদুর খোঁজ আর মেলে না। কেউ বলল, ভাদু শোকে আত্মঘাতী হয়েছে নদীর জলে। কেউ বলল, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছিল ভাদু, আবার ফিরে গেছে আকাশেই। বাকিরা বলল, ভাদু ভেসে গেছে নদীর কান্নার সঙ্গে। সেই থেকে ভাদুর গান ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের নানান কোণে।

    এই গল্প বিশ্বাস করতে বড়ো সাধ হয়। যদিও, বীরভূমে গেলে দেখা যাবে ভদ্রাবতী নাকি পুরুলিয়ার নন, হেতমপুরের রাজকন্যে। বর্ধমানের রাজপুত্রকে মন দিয়েছিল সে। ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতরা যখন মেরে ফেলল রাজুপুত্রকে, তখন তার সঙ্গেই সহমরণে গেছিল ভদ্রাবতী। সেই যন্ত্রণার ইতিহাসই নাকি বোনা ভাদু গানে।

    ভাদুকে ঘিরে এইসমস্ত গপ্পের সময়ই খুব বেশি হলে দেড়শো-পৌনে দুশো বছর আগেকার। সেদিনের রাজকন্যে ভদ্রাবতী। অথচ, এই রাজকন্যেকে নিয়ে গানই যে কীভাবে মাটির এত কাছের গান হয়ে উঠল, ভাবতে অবাক লাগে। আরো অবাক লাগে, ভাদু গানের সঙ্গে জড়ানো রীতিকে দেখলে। পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা ঘরে ভাদু প্রতিষ্ঠা করে। ভাদ্র সংক্রান্তির আগের রাতে ভাদু জাগরণ হয়। তারপরে, শুরু হয় ভাদু গান। ভাদ্র সংক্রান্তির সকালে ভাদু বিসর্জন যায় জলে। বীরভূমে এই প্রথা খানিক আলাদা। সেখানে ভাদু উৎসবের গানে যোগ দেয় পুরুষরাও। ভাদুর মূর্তি নাকি ছিল না আগে। ফুল রেখে বা গোবরে ধান দিয়ে মূর্তি কল্পনা করা হত। কিন্তু, এখন মূর্তি এসেছে। সেই মূর্তিরও নানা রূপ। কোথাও ভাদু হংসে উপবিষ্টা, কোথাও বা পদ্মে। ব্রাহ্মণ্য ঘরানার মূর্তির ঘেরাটোপে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে লোক-কল্পনার ভাদু।

    সব মিলিয়ে, ভাদু গান, ভাদুর কিংবদন্তিকে বড়ো ভালোবেসে জড়িয়ে রাখে রহস্য। ঔপনিবেশিক সময়ের এক রাজকন্যের গল্প কীভাবে এমন একটি লোকউৎসবের জন্ম দেয়—তা নিয়ে বিশদে তর্ক চলতে পারে। কেউ কেউ বলেন, ভাদুর গপ্প আসলে আরো সুপ্রাচীন। এই গপ্পে পঞ্চকোট বা হেতমপুরের রাজপরিবারের ইতিহাসকে জোড়া হয়েছে পরে। যেভাবে, লোকগান ভাদুকে দরবারি আঙ্গিকে জুড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পঞ্চকোট রাজারা। কেউ বলেন অন্য কথা। ভাদুর সুরের মতোই, গানের মতোই ভাদুকে ঘিরে থাকা ইতিহাস, গল্প, প্রথারা ভেসে ভেসে যায় দূর-দূরান্তরে। পুরুলিয়া, বীরভূম ছাড়াও বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, আসানসোল, এমনকি রাঁচি, হাজারিবাগেও।

    এমন রহস্য না থাকলে হয়তো প্রেমের কল্পনারাও শুকিয়ে যায়।  

    তথ্যসূত্রঃ দিলীপ কুমার গোস্বামী, সীমান্ত রাঢ়ের লোকসংস্কৃতি, মৃদুল দাশগুপ্ত, ফুল ফল মফস্‌সল, রোববার, প্রতিদিন, ২৭ আগস্ট, ২০১৭
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @