অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো…

শারদ পার্বনের শেষে বাতাসে হিমেল হাওয়া আর সন্ধ্যার পর কোনো কোনো গৃহস্থ বাড়ির ছাদে জ্বলে থাকা আকাশপ্রদীপের আলো জানান দেয় এখন কার্তিক মাস। দুর্গাঠাকুর বিসর্জনের পর মণ্ডপে জ্বলতে থাকা একাকী প্রদীপের আলো মনে করিয়ে দেয় লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো আসন্ন। দীপাবলি; যে রাতে অমাবস্যার আঁধার দূর হয়ে যায় মাটির প্রদীপ, মোমবাতি আর বৈদ্যুতিন আলোর উজ্জ্বল উপস্থিতিতে। বাতাসে পুজোর ভোগের গন্ধের সঙ্গে মিশে যায় আতসবাজির গন্ধ। আলোর উৎসবে মেতে ওঠে সারা ভারতবর্ষ।
বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিবছর কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় দীপান্বিতা কালীপূজা এবং লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী পুজো। তবে এই তিথির সঙ্গে আলোর যোগ কোথায় তা জানতে হলে ফিরে তাকাতে হবে পুরাণের দিকে। যদিও এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। একটি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী চৌদ্দ বছর বনবাসের পর এই তিথিতেই রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরেছিলেন তাই সেদিন অযোধ্যা আলোর সাজে সেজে উঠেছিল। সেই ঘটনাকে মনে রেখেই সারা দেশে দীপাবলি পালন করা হয়। আবার আরেকটি মত অনুযায়ী এই তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ ভূদেবী এবং বরাহর পুত্র অত্যাচারী শাসক নরকাসুরকে বধ করে ১৬,০০০ নারীকে উদ্ধার করেন। সেই আবহমানকাল থেকে শ্রীকৃষ্ণের বিজয়োৎসব উপলক্ষ্যে দীপাবলিতে আলো জ্বালানোর রীতি চলে আসছে। তবে শুধু ভারত নয়, ভারতের বাইরেও অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষরা সামিল হন এই আলোর উৎসবে।
শুধু অমাবস্যা নয়, তার আগে ধনত্রয়োদশী তিথি থেকেই শুরু হয়ে যায় আলোর উৎসব, চলে প্রায় ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া পর্যন্ত। শহর থেকে গ্রাম, গলি থেকে রাজপথ, ছোটোছোটো বাড়ি থেকে প্রাসাদ এই সময় সব জায়গারই ঠিকানা হয় কেয়ার অফ লাইট। তবে যারা আমাদের এই সময় দুনিয়াকে আলোতে ভরিয়ে রাখেন সেই আলোর শিল্পীরা কতটা আলোয় থাকেন? মাটির প্রদীপ নাকি হাল আমলের টুনি লাইট বা ব্যাটারি মোমবাতি কোনদিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা? রাস্তার আলোক সজ্জাতে এসেছে কী ধরনের পরিবর্তন? ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে তারই হাল হকিকত জানার চেষ্টা করলো বঙ্গদর্শন.কম।
প্রদীপ-কথা
প্রদীপের সঙ্গে বাঙালির আবেগ চিরকালের। প্রতিদিন কত বাড়িতে আজও সন্ধ্যা নামে তুলসী মঞ্চে জ্বলা প্রদীপের স্নিগ্ধ আলো আর শাঁখের আওয়াজকে সঙ্গী করে। আর আলোর উৎসবে সেই প্রদীপ যে বিশেষ জায়গা অধিকার করবেই সে কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। রাস্তার দু-ধারে বিভিন্ন নকশার মাটির প্রদীপের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। ব্যাটারি আর ইলেকট্রিক আলোর আধিপত্যের মাঝেও দীপাবলিতে সাবেক মাটির প্রদীপের আলো যেন মহালয়ার ভোরে রেডিওর মহিষাসুরমর্দ্দিনীর মতোই আবেগের আরেক নাম। তাই এই সময় প্রদীপের বিক্রিও খারাপ হয় না বলেই জানালেন এক বিক্রেতা। কোথায় তৈরি হয় এত মাটির প্রদীপ? এক বিক্রেতা জানালেন কলকাতার বাজারে মাটির প্রদীপ আসে মূলত উল্টোডাঙ্গার দক্ষিণদাঁড়ি, কুমোরটুলি ও ইছাপুর অঞ্চল থেকে। কিন্তু এই মরশুম ছাড়া কি তৈরি হয় প্রদীপ? এক উৎপাদনকারী জানালেন, “সারাবছরই আমরা প্রদীপ বানাই, অন্য রাজ্যেও পাড়ি দেয় আমাদের হাতে তৈরি প্রদীপ। তবে এই সময় চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে।” তবে মাটির দাম বেড়ে যাওয়া, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা ইত্যাদি প্রতিকূলতা চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে প্রদীপ শিল্পীদের কপালে। তবু এই মরশুমে বাড়তি রোজগারের আশায় মৃৎশিল্পের চাকা ঘুরিয়ে চলেন শিল্পীরা; তৈরি হয় চিরাচরিত থেকে আধুনিক নানা নকশার মাটির প্রদীপ।
মাটির প্রদীপ নাকি হাল আমলের টুনি লাইট বা ব্যাটারি মোমবাতি কোনদিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা? রাস্তার আলোক সজ্জাতে এসেছে কী ধরনের পরিবর্তন? ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে তারই হাল হকিকত জানার চেষ্টা করলো বঙ্গদর্শন.কম।
চন্দননগরের চলন্ত আলো
পুজোর আলোকসজ্জার কথা বললে বিশাল আলোর গেট, রাস্তার ধারে আলোয় ফুটে ওঠা ঈশপের গল্প, ধারাপাত বা সমসাময়িক বিষয়ের ওপর নির্মিত চলমান আলোর কথা মনে পড়বে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। টুনি বা এলইডির পূর্ব যুগেই মানুষকে এই ছুটে চলা আলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল চন্দননগর। আর এই পথের পথিকৃৎ শ্রীধর দাস (পড়ুন: শ্রীধর দাস – চন্দননগরকে আলো দেখিয়েছেন যিনি)। শুধু রাস্তা নয়, জলের নিচেও আলোকসজ্জা করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। শুধু দেশ নয় প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, ইংল্যান্ডের টেমস্ ফেস্টিভ্যালও সেজে উঠেছে এই বঙ্গসন্তানের আলোর কারুকার্যে। আর ভারতের উৎসব তো চন্দননগরের আলো ছাড়া অসম্পূর্ণ। যুগ বদলেছে, এসেছে টুনি বাল্ব তারপরে এলইডি। আলোর কাজ হয়েছে অপেক্ষাকৃত সহজ, আলোকসজ্জাতেও এসেছে নতুনত্বের ছোঁয়া তবে মণ্ডপ বা পাড়ার আলোকসজ্জার ক্ষেত্রে এই ছুটে চলা আলো আজও সমানভাবে জনপ্রিয়।
কলকাতার এজরা স্ট্রিট
শুধু তো পাড়া নয়, দীপাবলিতে আলো জ্বলে ঘরে ঘরে। সেখানে সাবেক প্রদীপ বা মোমবাতির পাশাপাশি সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে তারে গাঁথা বৈদ্যুতিন আলোর মালা পরে বাড়িগুলো যেন জয় করে কৃষ্ণপক্ষের তমসাকে। আর সেই উপলক্ষ্যে কলকাতার বৃহত্তম বৈদ্যুতিন আলোর বাজার এজরা স্ট্রিটেও জমে ওঠে আলোর কেনাকাটা। দেশিয় আলো নাকি চিন থেকে আমদানি করা আলো কোনটার চাহিদা বেশি? এজরা স্ট্রিট ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে মহম্মদ ইফতেকার বঙ্গদর্শন.কম-কে জানান, “চিন থেকে আমদানি করা আলোর চাহিদাই বেশি। কারণ এই আলোগুলো দামেও সস্তা আর দেখতেও সুন্দর। তাই এই আলোই সবাই পছন্দ করেন।” তিনি আরও বলেন কলকাতার এই অঞ্চল তো মরশুমি বাজার নয়, বরং দিল্লিতে আলোর বাজার তৈরির আগে এটাই ছিল এশিয়ার বৃহত্তম বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির বাজার। তাই এখানে আলোর চাহিদা প্রায় সারাবছরই থাকে। তবে এই সময় আরও অনেক অস্থায়ী বিক্রেতা ব্যবসা করতে এখানে আসেন। কেমন চলছে কেনাকাটা? এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বছর সাম্প্রতিক অস্থিরতার ছাপ পড়েছে আলোর বাজারেও। তাই অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর ক্রেতাদের ভিড় অনেকটাই কম এজরা স্ট্রিটে।
উপনিষদে ব্যক্ত তমসা থেকে জ্যোতির পথে যাত্রার শ্লোক প্রতিবছর যেন মূর্ত হয়ে ওঠে কার্তিক মাসের এই সময়টায়। কিন্তু শুধু বহিরঙ্গে নয়, দীপাবলির আলো মনের কোণের সব দীনতা, মলিনতা কাটিয়ে সমাজকে দেখাক নতুন দিশা। অবসাদ, বিষাদ, কুটিলতার অন্ধকার ঘুচিয়ে সকলের মনের আলোয় সেজে উঠুক ধরিত্রী, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক আলোর জয়বাণী।