দেশ অথবা মনভাগের একটি আখ্যান

দেশভাগের অর্থ ঠাকুমা-দাদুর কাছে যন্ত্রণা, বাবার কাছে স্মৃতি আর আমার কাছে গল্প। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার ঠিক দু’দিনের মধ্যে র্যাডক্লিফ লাইন টেনে দেওয়া হয়। এর ফলে বাংলা আর পঞ্জাব প্রদেশের লক্ষ, লক্ষ মানুষ নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়ে রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশভাগের পর প্রথম ৯ বছরে প্রায় ২১ লক্ষ মানুষ বাধ্য হয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে চলে আসে। অসম, ত্রিপুরা আর কলকাতার বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে এদের ঠাঁই হয়। পার্মানেন্ট লাইবেলিটি বা পিএল-এর পরিচয়ে শুরু হয় তাদের নতুন জীবন। যে জীবনের বর্তমান গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা আর ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার চাদরে মোড়া। ছিন্নমূলের যন্ত্রণা সারাজীবন এই মানুষদের ভোগ করতে হবে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগের মাসে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ৬ জুলাই গণভোটের মাধ্যমে সিলেটকে অসম থেকে বিছিন্ন করে বাংলাদেশে সম্পূর্ণরূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দাঙ্গা আবহের মধ্যেই সিলেটের হবিগঞ্জের বাসিন্দা মনোরঞ্জন দত্ত (দাদু) তাঁর স্ত্রী যুথিকারাণী দত্ত (ঠাকুমা) ৭ বছরের পুত্র মানস দত্ত (বাবা) সহ সাত ভাই-বোনকে নিয়ে প্রথমে শিলচর স্টেশন সংলগ্ন ক্যাম্প, পরে শিয়ালদহ স্টেশন উদ্বাস্তু শিবিরে প্রাণ বাঁচানোর লড়াই করে; শেষমেশ এক আত্মীয়ের সহযোগীতায় গিয়ে উঠলেন মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। ঠাকুমা-দাদুকে দেখেছি এই ক্ষত সারাজীবন বহন করতে। প্রশ্ন করেছি অনেক। উত্তর পাইনি কোনও। সেই বয়সে না বুঝলেও, এখন বুঝি ভিটেমাটি ছেড়ে আসার কষ্ট তাঁরা কারও সঙ্গে ভাগ করতে নারাজ।
মাঝে বেশ কয়েকটি দশক আমরা পার করে এসেছি। দেশভাগ আমাদের ইতিহাসের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জীবনেরও এক অবিছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। সাহিত্য, সিনেমা, সঙ্গীত, প্রদর্শনী, আলোচনা সভায় বারবার উঠে এসেছে সেই সময়ের কথা। ১৭-২৯ অগাস্ট তেমনি এক প্রদর্শনী হয়ে গেল ‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’তে। ‘দ্য লেগাসি অব লস: পারস্পেকটিভস অন দ্য পার্টিশন অব বেঙ্গল’ নামক এই প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল প্রফেসর ঋতুপর্ণা রায়ের কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়াম। সহযোগীতায় টাটা স্টিল, ইমামি ফাউন্ডেশন। সমগ্র প্রকল্পের ভাবনা ও রূপায়নে রাজশ্রী মুখোপাধ্যায়। পাঁচজন শিল্পীর অসামান্য সৃষ্টিতে উঠে এসেছিল দেশভাগের দগদগে স্মৃতি। শেষদিন এই প্রদর্শনী চাক্ষুষ করার সুযোগ মেলে।
বিনায়ক ভট্টাচার্য একসময় সীমান্তের কাছে অশোকনগরে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। তাঁর রিলিফ প্রিন্ট, স্থিরচিত্রে উঠে এসেছে কাঁটাতারের আখ্যান। সীমান্তঘেঁষা মানুষের দুঃখ-কষ্ট, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোখ রাঙানি, আবার সব নিয়মকে তুচ্ছ জ্ঞান করে দুই দেশের মধ্যে দিয়ে ইছামতি নদীর বয়ে চলা উঠে এসেছে তাঁর সৃষ্টিতে। নকশিকাঁথা, উডব্লক প্রিন্টে ওপার বাংলাকে ধরতে চেয়েছেন পলা সেনগুপ্ত। ফেলা আসা জীবনের স্মৃতি ফুটে উঠেছে তাঁর ইনস্টলেশনে। নিজের কলোনি জীবনকে জলরং, স্কেচবুক চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন দিলীপ মিত্র। তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি যেন নিজেই নিজের জবানবন্দী দিতে চায়। দেশভাগের সঙ্গে এই তিন শিল্পীর পরিবার সরাসরি জড়িয়ে থাকলেও বাকি দুজন শিল্পীর পরিবার দেশভাগের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। অমৃতা সেন তাঁর অ্যাকর্ডিয়ন বুক-এর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন দেশভাগের যন্ত্রণা। যেখানে ঋত্বিক ঘটকের ছবি, বিশেষত কোমল গান্ধার-এর বিভিন্ন দৃশ্য উঠে এসেছে। গঠনশৈলীর দিক দিয়ে জাপানিস বা চাইনিজ অ্যাকর্ডিয়নের থেকে আলাদা হলেও এর নিজস্ব একটা ধারা বজায় রেখেছেন শিল্পী। বইয়ের নামটি মন ছুঁয়ে যায়, দেশভাগ/মনভাগ। আবার আরশি নগরের মাধ্যমে উঠে এসেছে লালনের দর্শন। ভাষা, সংস্কৃতি এক: তাও আজ আমরা পড়শি। দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কাজ একটা অদ্ভুত মাদকতা তৈরি করে। বিশেষ করে তাঁর হুপ ম্যাপিং। ছাপড়াতে জীবনের ২২টা বছর কাটিয়ে দেওয়া শিল্পীর মননে সেখানকার রেল কলোনি জীবনের ছাপ সুস্পষ্ট। নামী ফ্যাশন হাউসে কর্মজীবন শুরু বলেই হয়ত দেবাশিসের শিল্প দর্শনে টেক্সটাইলের বড়ো ভূমিকা রয়েছে। যার প্রভাব এই প্রদর্শনীতেও দেখা যায়।
পরিশেষে বলতে পারি, এক অসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি। কল্পনার অনেক খণ্ডচিত্র চোখের সামনে উপলব্ধি করলাম। কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়াম ও কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটিকে সাধুবাদ জানাই এমন উদ্যোগের জন্য। দিল্লির মিউজিয়াম অব মেটেরিয়াল মেমরি দেখে মনে আক্ষেপ ছিল, বাংলাতেও যদি এমন কিছু শুরু হয়। কারণ দেশভাগ নিয়ে পঞ্জাবকে কেন্দ্র করে যত কাজ হয়েছে বাংলাকে নিয়ে তার সিকিভাগও হয়েছে কিনা সন্দেহ। আশা রাখব কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়াম সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে বড়ো ভূমিকা নেবে।
আলোকচিত্র- লেখক