বাঘা মসজিদে সুলতানি থেকে মুঘল ইতিহাস এখনও জ্যান্ত

রাজশাহীর বাঘা মসজিদে প্রত্যেক বছরই শীতের মরসুমে বহু মানুষ বেড়াতে যান। টেরাকোটার সূক্ষ্ম কাজ আর সুলতানি যুগ থেকে চলে আসা সুফি ঐতিহ্যই মানুষকে প্রধানত এখানে টেনে আনে। তার সঙ্গে রয়েছে পাঁচশো বছর ধরে চলা তিন দিনের জমজমাট ইদ-উল-ফিতরের মেলা। মসজিদের সামনে থাকা ঐতিহাসিক দীঘিতে শীতকাল নাগাদ সারা পৃথিবী থেকে পরিযায়ী পাখির ঢল নামে, সেটাও ভ্রমণপিপাসু আর পিকনিকপ্রেমীদের কাছে প্রধান একটা আকর্ষণ।
বাংলায় যখন হোসেন শাহ রাজত্ব করতেন, তার আগের নথিতে মখদুমপুরের পশ্চিম দিকে বাঘা নামের কোনো জায়গার নামই পাওয়া যায় না। পদ্মার তীরে ওই অঞ্চলটা ছিল গভীর জঙ্গল। বাঘের ভয়ে মানুষ সেখানে যেত না। হোসেন শাহের রাজত্বকালে ১৫০৫ সালে বাগদাদ থেকে একজন ফকির তাঁর কয়েকজন শিষ্যকে নিয়ে এসে ওই জঙ্গলে থাকতে শুরু করেন। সাধন-ভজনের প্রয়োজনে এইরকম নির্জন একটা জায়গাই তাঁদের পছন্দ ছিল। তারপর আস্তে আস্তে সেখানে ভক্তদের আনাগোনা হতে লাগল, মানুষ এসে জঙ্গল কেটে বাড়িঘর বানানো শুরু করল, আর বাঘের আড্ডা হিসেবে পরিচিত সেই জঙ্গলে তৈরি হওয়া জনবসতির নাম হয়ে গেল ‘বাঘা’।
কেউ কেউ মনে করেন, বাগদাদ থেকে আসা সেই ফকির হজরত শাহ দানিশ মন্দ ছিলেন আরবের বিখ্যাত খলিফা হারুন-অল-রশিদের বংশধর। বাঘায় তিনি একটি মক্তব আর খানকাহ তৈরি করেছিলেন। বাগদাদ থেকে আসা তখনকার দিনের বিশিষ্ট পণ্ডিত মৌলানা শের আলি ছিলেন মক্তবের অধ্যক্ষ। হজরত শাহের মৃত্যু হলে তাঁর ছেলে হামিদ দানিশ সেই মক্তবটিকে মাদ্রাসায় উত্তীর্ণ করেন। ইসলামি ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় মক্তব আর উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় মাদ্রাসা। হামিদ দানিশ বাংলার শাসক তখনকার সুলতান নসরত শাহের সাহায্যে বাঘায় একটা মসজিদ বানিয়ে ফেলেন। সুলতানের উদ্যোগে মসজিদের সামনে একটা দীঘিও খনন করা হয় তখন।
মুঘল সম্রাট শাহজাহান পরবর্তীকালে মদদ-ই-মাস হিসেবে বিয়াল্লিশটি মৌজা দান করেন হামিদ দানিশের তিন নম্বর ছেলে মৌলানা আব্দুল ওয়াহাবকে। তখনকার সময়ে পণ্ডিত ব্যক্তি এবং সাধু-সন্তদের ভরণপোষণের জন্যে শাসকরা যে জমি দান করতেন, সেগুলোকেই বলা হত মদদ-ই-মাস। আব্দুল ওয়াহাবের সময় বাঘা মাদ্রাসার খুব নাম ছড়িয়েছিল। দেশ-বিদেশের ছাত্ররা পড়তে আসতেন এখানে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মাদ্রাসার বাড়িটি ভেঙে পড়লে সেখানকার পড়াশোনা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এর আগেই অবশ্য সেই মাদ্রাসার অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল।
এখন যাঁরা বাঘা দেখতে যান, মূলত তাঁরা ঘুরে দেখেন সুলতান নসরত শাহের মসজিদ, দীঘি, হামিদ দানিশ এবং অন্যান্য সাধকদের সমাধি এবং আমবাগান। শিল্পরসিকদের কাছে অবশ্য মসজিদটির নান্দনিক আকর্ষণ সবথেকে বেশি। মসজিদে চুন সুড়কির গাঁথুনিতে রয়েছে দশটা গম্বুজ আর ছ’টা স্তম্ভ। মাঝখানে দরজার ওপর রয়েছে ফার্সি ভাষায় লেখা একটা শিলালিপি। উত্তর-পশ্চিম কোণে উঁচুতে তৈরি একটা বিশেষ নামাজের ঘর দেখা যায়। ভেতরে ও বাইরে পোড়ামাটির ফলকে আমগাছ, শাপলা ফুল, লতাপাতা, ফার্সি ক্যালিগ্রাফি ফুটে উঠেছে। মসজিদের পুব দিকের দীঘিতে সম্প্রতি পাড় বাঁধানো হয়েছে, চারদিকে রয়েছে নারকেল গাছের সারি।
রেল-সড়ক-আকাশ এই তিন পথেই ঢাকা থেকে রাজশাহী যাওয়া যায়। বাঘা পৌঁছতে রাজশাহী সদর বাস টার্মিনাল থেকে বাস ধরতে হবে। কখনও যদি হাতে সময় নিয়ে বাংলাদেশ ঘুরতে যান, এই বাঘা মসজিদ মিস না করাই ভালো। ইতিহাস, শিল্প, আধ্যাত্মিকতা এবং প্রকৃতির আশ্চর্য সমাহার যে কোনো দর্শককেই মুগ্ধ করবে এখানে।
ছবি সূত্র – মুহাম্মদ হাসান