বিস্মৃত বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্রমোহন বসু

কলকাতার এক অন্ধকার সংগ্রহশালায় কিছু ধুলোমাখা পুরনো রেকর্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে, কয়েক বছর আগে ‘এইচ বোসেস রেকর্ডস’ নজরে আসে। ১২৫ বছর আগে অনেকগুলি শিল্প স্থাপন করেছিলেন যিনি, সেই হেমেন্দ্রমোহন বসুর কথা জানতে পেরে বিস্মিত হই। আমরা অনেকেই তাঁর সম্পর্কে বিশেষ জানি না। বাংলার সে-সময়ের গর্বোজ্জ্বল একটি অধ্যায় আমরা সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছি। বাঙালিদের সম্পর্কে প্রায়শই বলা হয়, ব্যবসা করার দক্ষতা নেই তাদের। আমরা যদি এক শতাব্দীরও আগেকার এক বাঙালির ব্যবসায়িক বুদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতাম তাহলে আজ সারা ভারতের এমন ধারণা হত না বাঙালিদের সম্পর্কে।
অতএব, আমি হেমেন্দ্রমোহন বসু-র সম্পর্কে কলম ধরার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর, নিজের উৎসাহের সঙ্গে মিল পেলাম একটা জায়গায় – ব্যবসা, গান, সাহিত্য, নতুন জিনিস উদ্ভাবন ইত্যাদিতে মন দেওয়া এবং সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে। হ্যাঁ, ১২৫ বছর আগে এক বাঙালি বর্তমান ছিলেন যিনি এসব করেছিলেন। আমার মতে, শুধুই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস হিসেবে একে চিহ্নিত করা উচিৎ হবে না। এখনও প্রচারের বাইরে থেকেও অনেকেই পূর্বসূরিদের ঐ গৌরব বহন করেছেন এবং নিজেদের কাজ করে চলেছেন।

হেমেন্দ্রমোহন বসু সেই যুগের মানুষ ছিলেন যখন বাঙালিরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠের সিলিন্ড্রিকাল রেকর্ডিং উদ্বুদ্ধ করেছিল মানুষকে। একজন বাঙালি উদ্যোগপতি স্বদেশে তৈরি সিলিন্ডারে কণ্ঠস্বর রেকর্ড করছেন – এটাই একপ্রকার বিপ্লব ছিল। হেমেন্দ্রমোহন পরিচিত হন ‘স্বদেশি সিলিন্ড্রিকাল রেকর্ডের জনক’ হিসেবে।
২১ বছর বছর বয়সে হেমেন্দ্রমোহন সুগন্ধী দ্রব্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৪ সালে সুগন্ধী দ্রব্য তৈরির ব্যবসা শুরু করেন তিনি, ‘দেলখোস’ নাম দিয়ে। এরপর অন্যান্য জিনিস তৈরিতেও মনোযোগ দেন এই উদ্যোগপতি। যেমন চুলের তেল, ওডিকোলন ও অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্য। তাঁর ‘কুন্তলীন তেল’ পূর্বভারতে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছিল এবং তিনি কলকাতার ৬, শিব নারায়ণ দাস লেনে দ্বিতীয় কারখানাও খোলেন।
হেমেন্দ্রমোহনের একনিষ্ঠতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি উৎসাহ ও দক্ষতা তাঁকে সিনেমাটোগ্রাফি, সাউন্ড রেকর্ডিং, সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি, মোটরগাড়ি, প্রিন্টিং ইত্যাদি ক্ষেত্রেও চালিত করেছিল। ১৯০০ সালে তিনি একটি দু-সিটের মোটরগাড়ি কেনেন এবং কিছুদিন পরেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্রেট ইস্টার্ন মোটর কোং’। পাশাপাশি, পার্কস্ট্রিটে গাড়ি সারানোর একটি কারখানাও, ‘গ্রেট ইস্টার্ন মোটর ওয়ার্কস’ নামে। ১৯০৩ সালে হেমেন্দ্রমোহন প্রথম ভারতীয় সাইকেল কম্পানি স্থাপিত করেন। ‘এইচ বোস অ্যান্ড কোং সাইকেলস’। পাশাপাশি, কম্পানিটি ভারতে রোভারস সাইকেলের ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বও নেয়। অটোক্রোম লুমিয়ার স্লাইড ব্যবহার করে কালার ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রেও ভারতে পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। ‘স্পোর্টস ইউনিয়ন অব ক্যালকাটা’ও স্থাপন করেন ক্রীড়ামোদী এই ব্যক্তি।

হেমেন্দ্রমোহন বিখ্যাত হতে শুরু করেন ১৯০০-এর কাছাকাছি সময়ে, যখন তিনি প্রিন্টিং ইউনিট সহ একটি পাবলিশিং হাউস শুরু করেন ‘কুন্তলীন প্রেস’ নামে। একই সঙ্গে, সিলিন্ডারে রেকর্ড করার রেকর্ডিং কম্পানিও। বাঙালি তরুণ সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করার জন্য, রবীন্দ্রনাথের সহযোগিতায় ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ চালু করেন তিনি। এই পুরস্কার প্রথম পেয়েছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। পরবর্তীকালে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। এমন বিশ্বাস করাই যায়, বর্তমানের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার,রবীন্দ্র পুরস্কার ও অন্যান্য বিভিন্ন সাহিত্যের পুরস্কার অনুপ্রাণিত হয়েছিল কুন্তলীন পুরস্কার থেকেই।
হেমেন্দ্রমোহন সাউন্ড রেকর্ডিং ও ‘প্যাথে’ ফোনোগ্রামের ব্যবসায় পরবর্তীকালে মনোনিবেশ করেন। নতুন কিছু-র প্রতি অদম্য উৎসাহের ফলে নিজের সাইকেল বিক্রির দোকান খোলেন ১৯০৪ সালে। এর সাফল্য তাঁকে আরও উৎসাহিত করে এবং ‘এইচ বোসেস রেকর্ডস’ নামে সিলিন্ড্রিকাল রেকর্ডের ব্র্যান্ড আনেন বাজারে। এর গুণমান অত্যন্ত উন্নতমানের ছিল এবং বিজ্ঞাপন করা হত ‘বিশুদ্ধ গান এবং গান ছাড়া আর কিছুই নয়’ – এই বলে।
আজকের তরুণ উদ্যোগপতিরা, যারা নিজেদের উৎসাহে ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সারা দেশেই, তাঁদের পূর্বসূরি এই বাঙালি ভদ্রলোক – হেমেন্দ্রমোহন বসু – আমাদের থেকে আরেকটু সম্মান কি প্রাপ্য নয় ওঁর?