No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    অরণ্যে ছাওয়া সুন্দরবন আর গ্রামের নামটি ‘বিধবা’

    অরণ্যে ছাওয়া সুন্দরবন আর গ্রামের নামটি ‘বিধবা’

    Story image

    সুধীন খুঁজছে যমুনাকে। যমুনা তার বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করত। সুধীনের এক পরিচিত বিধবা বৃদ্ধা তাকে নিয়ে লোপাট। যমুনার পেটে সুধীনের এক বাদলা রাতের অসংযমের ফল রয়েছে। কিন্তু কতদূর তার খোঁজ? যমুনাদের গ্রামের নাম সে জানে না, তবে জানে সুন্দরবনের কোথাও একটা ‘বিধবা গ্রাম’ ফেলে আরও দক্ষিণে পাঁচ-সাত গ্রামের পর তাদের গ্রাম। কিন্তু এখানে বিধবা গ্রাম কি একটা! সে লঞ্চে এক সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করলে সহযাত্রী পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “বেধবাদের গ্রাম? গ্রামের নামটা কী? ...গ্রামের জন্ম থেকেই তো কেউ আর বিধবা হয়ে জন্মায়নি! আগে গ্রামের মায়েরা বউয়েরা বিধবা হয়েছে, তবে না ‘বিধবাদের গ্রাম’ হয়েছে!”

    সুধীনকে আমরা কেউ কেউ চিনি, অনেকেই চিনি না। সুধীন, অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর ‘জিপসি রাত’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সুধীন হতে পারে ফিকশনাল, কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের ‘বিধবা গ্রাম’ জ্যান্ত বাস্তব। এবং এই ‘বিধবা গ্রাম’ একটা নয়, অনেক।

    পূর্ব ভারতের ৪,২০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বদ্বীপ, ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছাওয়া, সুন্দরবন। সেখানে অন্তত ১১টি গ্রাম এই নামেই চিহ্নিত স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে। এছাড়াও গ্রামে গ্রামেই রয়েছে ‘বিধবা পাড়া’। হিঙ্গলগঞ্জ, গোসাবা, কুলতলি, পাথরপ্রতিমা, বাসন্তী, ঝড়খালি, সন্দেশখালি ব্লকের বহু গ্রামে একটা করে বিধবা পাড়া ঢুঁ মারলেই চোখে পড়বে। কেন এত বিধবার ভিড়, কেন এত বেরঙের ছিটে!

    কলকাতা মহানগরী ছেড়ে অনেকটা দূরে নিজেদের বিশ্বাসে, সংস্কারে, প্রকৃতির সঙ্গে নিয়ত সংগ্রামে বেঁচে আছে কিছু মানুষ। একটু অসাবধানতা কেড়ে নেয় স্পন্দনটুকু। মাছ ধরতে, কাঁকড়া ধরতে কিংবা মধু সংগ্রহ করতে রোজকার জঙ্গলে, দ্বীপে, খাঁড়িতে ঘুরতে হয় মানুষগুলোকে। এখানে বাঘের হাতে মৃত্যু যেন বা নিয়তির মতো অমোঘ; ম্যানগ্রোভের সমার্থক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত তিন দশকে প্রায় ৩,০০০ পুরুষ এভাবে বাঘের থাবার নিচে পড়েছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে প্রায় ১০০ পুরুষ। ১০০ পুরুষের মৃত্যু রেখে যায় ১০০ বৈধব্য। বিধবা নারী। পুনর্বিবাহ সংস্কারে নেই। ফলে গ্রামে গ্রামে বিধবা পাড়া। কখনো বা গ্রামই বিধবা।

    পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন দপ্তর, মৎস্য দপ্তর এবং সরকারের যৌথ ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমা প্রকল্প থেকে মহিলাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হয় প্রায় ৪-৫ লক্ষ টাকা। তবে স্বামীর মৃত্যু জঙ্গলের কোর এরিয়ায় হলে চলবে না, মৃত্যুর সময়ে থাকতে হবে বোট লাইসেন্স, থাকতে হবে বন দপ্তরের অনুমতি পত্র এবং আরও বহু তথ্য প্রমাণ নথি।

    এই ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গলের ১,৭০০ বর্গ কিলোমিটার কোর এরিয়া এবং ৯০০ বর্গ কিলোমিটার বাফার এরিয়া। কিন্তু জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে, দ্বীপে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে সবসময় তারাও হয়তো বুঝতে পারে না, কোথায় কোর এরিয়া শুরু, কোথায় বাফার শেষ; ঠাওর করতে পারে না সেসব। কোর-বাফার মানে না বাঘ - ওঁত পেতে আছে সর্বত্র - একটু অসচেতনতা, অতঃপর মৃত্যু। বাঘ-মানুষের এই প্রাকৃতিক সংগ্রামে কোর-বাফার নিতান্তই খেলার মতো। কিন্তু পরিণতি স্বরূপ যে বৈধব্য, যে ফিকে জীবন, যে সাদা থান - সেখানে খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা কিছু মাত্রায় আছে, কিছু মাত্রায় নেই।

    নিয়তির আঘাত এলে, শোক কাটার অবকাশ নেই, তার আগেই পঞ্চায়েত, বিডিও, এসডিও, এনওস, বিএলসি- এর অনুমতিপত্র, তার চিঠি এবং কিছুটা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দোলাচল। সে সব মহিলা সংসার চালাতে, সন্তানদের ভাত জোগাতে চলে যায় কাঁকড়া-মাছের সন্ধানে বিলে, খাঁড়িতে, জঙ্গলে। এবং এভাবে, তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে ২২টি গ্রাম নিয়ে লাহিড়িপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ২৫০ জন মহিলা বাঘের থাবায় নিহত হয়েছেন। যে গল্প দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই যমুনার মা চিংড়ির মীন ধরতে গিয়ে কুমিরের কামড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা পড়েছিলেন। প্রসঙ্গত বলার, বাঘের পাশাপাশি কুমিরের আনাগোনা এখানে নিতান্তই কম নয়, তেমন রয়েছে পুরুষের পাশে মহিলা মৃত্যুর সংখ্যাও।

    যদিও সুন্দরবন গ্রামীন উন্নয়ন সমিতি বা দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের মতো বেসরকারি কিছু সংস্থা এই মহিলাদের হয়ে কাজ করছে, গলা তুলছে। তা প্রসংশনীয়। তাছাড়া অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেসের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) অনুযায়ী, পঞ্চায়েত মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, এসব গ্রামের বিধবাদের ১০ হাজার টাকা অনুদান, মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজ, বাংলার আবাস যোজনায় তাঁদের বাড়ি, নারেগা প্রকল্পে ১০০ দিনের কাজ ইত্যাদি দেওয়া হবে। এবং ঘোষণা অনুযায়ী ১১টি গ্রামের মধ্যে ২-৩টি গ্রাম দত্তক নিয়ে বিধবা মহিলা ও সন্তানদের কাজের সংস্থান করে দেওয়াও হয়েছে।

    তবুও আমরা জানি না দিনের শেষে স্বামী না ফিরলে কেমন লাগে তাদের, জানি না কোলের ছেলের শুকনো মুখ দেখে কেমন লাগে তাদের, জানি না বনবিবিকে ঠিক কোন জায়গা থেকে ভক্তি করে তারা, জানি না দমকা ঝড়ে সন্ধের প্রদীপটা নিভে গেলে কেমন লাগে। আমরা শুধু তথ্য দেখি আর অনুমান করি, অনুমান করি আর তথ্য দেখি।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @