মনের জোর আর অলীক নেশাই উতরে দিল প্রথম ম্যারাথন

দ্বিতীয় পর্ব
দৌড়ের স্বপ্ন জেগেছিল পাহাড়কে ঘিরেই অথচ পাহাড়েই যাওয়া হয়ে উঠছিল না। যখন সর্বোচ্চ ২১কিমি দৌড়েই ভাবছি লং ডিসট্যান্স রানিং-এ ইতি টানব, মাথায় এল এক অভিনব ট্রেকের কথা।
সিকিমের ইয়কসাম থেকে এক দৌড়ে গোচালা (৫০০০ মিটার উচ্চতা) যাব এবং নেমে আসব। এর আগে এই ট্রেক করেছি ৭ দিন ধরে, মনে করা হয় যথেষ্ট কঠিন ট্রেক। এবার সেটাই একদৌড়ে করার ভাবনা। কিন্তু ভাবলেই তো আর করে ফেলা যায়না। যদি মাঝরাস্তায় কোনও দুর্ঘটনার শিকার হই, ওই গভীর জঙ্গলের মাঝে উদ্ধার করার কেউ থাকবেনা! তাই ঠিক করলাম একটা ঠিকঠাক প্ল্যানিং আর টিম লাগবে। এই পাগলামির আইডিয়া স্যোশাল মিডিয়ায় পোষ্ট করলাম। ‘সঙ্গীদল গেল জুটি’। কিন্তু বাধ সাধল ওখানকার লোকাল এজেন্ট। যাকে ভালো করে আমাদের প্ল্যানিং বুঝিয়ে দেওয়ার পরেও কোনো নির্দেশ পালন করেনি, স্রেফ বিশ্বাস করতে পারেনি আমাদের। একদিনেও গোচালা পৌছানো সম্ভব? বাধ্য হয়ে আমরা সেদিন গোচালার পরিবর্তে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে জোংরি পৌছেছিলাম, এটিও আসলে ২-৩ দিনের ট্রেক। নেমে এসে শুনেছিলাম বৃষ্টির মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, দিনাজপুর প্লাবিত হয়ে রেললাইন, সড়কপথ সব ভেসে গিয়েছে।
আমার আইডিয়া শোনার পর এই দৌড়টির পরিকল্পনায় সাহায্য করেছিল অর্পিতাদি। অর্পিতা মৈত্র, নিজেও দৌড়েছিল। অর্পিতাদি নিজেও আল্ট্রাম্যারাথন রানার। আমার হাফ ম্যারাথনের টাইমিং শুনে আর পারফর্মেন্স দেখে ফুল ম্যারাথনে যাওয়ার উৎসাহ দিল। টিপস দিল কীভাবে ডিসট্যান্স ধীরে ধীরে বাড়াতে হয়।
এবার আবার উৎসাহ নিয়ে লেগে পড়লাম। প্রতি সপ্তাহান্তে লম্বা দৌড়ের দূরত্ব আগের সপ্তাহের থেকে ২ কিমি করে বাড়াতাম। এক বান্ধবীর সাহায্য নিয়ে ঠিকঠাক করে ডায়েটিং লিস্ট বানালাম। ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে দৌড়ের টিপস নিচ্ছি আর পায়ের জোর বাড়ানোর এক্সেরসাইজ করছি। যখন দেখলাম দূরত্ব বাড়াতে বাড়াতে একটানা ৩০ কিমি দৌড়তে পারছি, বুঝলাম ফুল ম্যারাথনে নামার সময় চলে এসেছে। নেট ঘেঁটে দেখলাম কাছাকাছি ওই সময় ভাইজাগ নেভি ম্যারাথন হচ্ছে। আর দেরি না করে রেজিস্ট্রেশন সেরে ফেললাম।
একটু ফ্ল্যাশব্যাক, খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৪৯০ বছর আগের ঘটনা। দুই চিরশত্রু গ্রীস আর পারস্যের মধ্যে যুদ্ধ চলছে গ্রীসের ম্যারাথন নামের এক শহরে। অবশেষে জয় এল গ্রীকদের, গ্রীক সৈন্য ফেলিপিডিস সেই জয়ের খবর দিতে ম্যারাথন থেকে দৌড়নো শুরু করে রাজধানী এথেন্সের রাজদরবারে। প্রায় ৪২ কিমি ঊর্দ্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে রাজদরবারে পৌছে চেঁচিয়ে ওঠে 'নেনিকামেন' (আমরা জিতেছি) এবং সম্ভবত মারা যায়।
ফেলিপিডিসের এই দৌড় স্মরণ রেখে শুরু হয় ম্যারাথন দৌড়, আধুনিক ম্যারাথনের দূরত্ব ৪২.১৯৫ কিমি। সমুদ্র আর পাহাড়ের ককটেলে ভাইজ্যাগ অদ্ভুত সুন্দর এক বন্দর শহর। পাহাড়ের উপর নীচে দিয়ে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে ম্যারাথন ট্র্যালকরুটটিও সেইরকমই সুন্দর। ৪২ কিমি! দৌড় শুরুর আগেও ভাবতে পারছিলামনা ঠিক কতটা কষ্ট লাগতে পারে, ঠিক কতটা দূর!
দৌড় শুরু হল ভোর ৪টায়, অন্ধকারে। ৩০ কিমি অব্দি প্র্যাক্টিস তো ছিলই, তাই চাপমুক্ত হয়ে দৌড় শুরু করলাম। ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে যখন সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে সূর্য উঠছে, রক্তাভ জলের গর্জনের দৃশ্য ভোলার নয়। ম্যারাথনের প্রস্তুতি শুরু করার পর এই দৃশ্যগুলো ছিল আমার পরম পাওয়া।
কষ্ট শুরু হল ৩০ কিমির পর থেকেই। আর পায়েতে কোনো অনুভূতি পাচ্ছিনা। যেকোনও সময়ে মনে হচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাব। অ্যাম্বুলেন্স দেখে মনে হচ্ছে রেস ছেড়ে উঠে শুয়ে পড়ি। শুধু মনের জোরটা ধরে রেখেছিলাম, শেষ করবই। শেষ করলাম ৪ ঘন্টা ৩৪ মিনিটে, আর মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
অ্যাথলিটদের দুনিয়ায় একটা কথা খুব চলে, যদি কিছু জিততে চাও তাহলে ১০০ মিটার দৌড়াও। আর যদি আজীবনের অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে চাও, ম্যারাথন দৌড়াও।
ততদিনে দৌড়ের দূরত্ব আরও বাড়ানোর নেশায় আমায় পেয়ে বসেছে!
(ক্রমশ)