No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    প্রথম বাঙালি প্রকাশক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য

    প্রথম বাঙালি প্রকাশক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য

    Story image

    ভাগ্যের পরিহাস ছাড়া আর কি বা বলা যেতে পারে! না হলে আমেরিকা আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্ব থেকে কেন বঞ্চিত হন কলম্বাস? কেন মার্কোনির বেতারজগৎ থেকে ব্রাত্য থাকেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু? আর কেনই বা বাঙালির প্রথম সংবাদপত্র সম্পাদক, মুদ্রাকর, প্রথম বাংলা সচিত্র বই-এর প্রকাশক - ইতিহাস বিশ্রুত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য হারিয়ে যান বিস্মৃতির গঙ্গায়?

    বাঙ্গাল গেজিটির সম্পাদক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য মেলে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সাহিত্য সাধক চরিতমালার ‘গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য’ গ্রন্থ এবং ১৩৮১ বঙ্গাব্দের দৈনিক দামোদর শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত দাশরথি তা'র অসাধারণ ক্ষেত্রসমীক্ষাভিত্তিক লেখা 'সারা ভারতের সাংবাদিক তীর্থ বর্ধমানের বহড়া' নিবন্ধটি থেকে।

    গঙ্গাকিশোর অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পূর্ব বর্ধমান জেলার গঙ্গাতীরবর্তী অগ্রদ্বীপ-গাজিপুরের সন্নিকটে বহড়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজের প্রচেষ্টায় ইংরেজি শিখে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিষ্ট মিশন প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানায় কম্পোজিটরের চাকরিতে যোগ দেন। পরে তিনি স্বাধীন ভাবে জীবিকার্জনের জন্য উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ার দিকে কলকাতায় চলে আসেন এবং বই প্রকাশ ও বই বিক্রয় ব্যবসায় নেমে পড়েন নব উদ্যমে।

    ইতিহাস বলে, প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এন্ড্রুজ সাহেবের হাত ধরে হুগলিতে ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। তারপর স্বল্প সময়ের মধ্যে কলকাতায় বেশ কয়েকটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন ক্রনিকল প্রেস, পোস্ট প্রেস, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপাখানা, ফেরিস এন্ড কোম্পানি প্রেস ইত্যাদি। শেষোক্ত এই প্রেসটি থেকে গঙ্গাকিশোর কবি ভারতচন্দ্রের সচিত্র অন্নদামঙ্গলকাব্য-টি ছাপেন ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে। অন্নদামঙ্গলকাব্যে তখনকার দিনের নামকরা শিল্পী রামচাঁদ রায়ের খোদিত ছ’খানি ধাতু খোদাই ও কাঠ খোদাই ছবি ছিল। এটাই ছিল ছাপার অক্ষরে বাঙালির সম্পাদনায় প্রকাশিত প্রথম ছবিওয়ালা বই।

    বইটি সম্পর্কে ১৮৩০ খ্রি ৩০শে জানুয়ারি সমাচার দর্পণে লেখা হয় – “...প্রথম যে পুস্তক মুদ্রিত হয় তাহার নাম অন্নদামঙ্গল শ্রীরামপুরের ছাপাখানার একজন কর্মকারক শ্রীযুত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য তাহা বিক্রয়ার্থে প্রকাশ করেন।" পাঠকদের কাছে এই বইটি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে হয়ে ওঠে। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৩১৮। বইটির প্রকাশকাল দুশো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। অথচ কোনো হেলদোল নেই সারস্বত জগতে!

    যাইহোক বইটির কাটতি দেখে গঙ্গাকিশোর অসম্ভব উৎসাহিত হয়ে নিজেই এবার প্রেস স্থাপন করার উদ্যোগ নিলেন। এ বিষয়ে তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সম্ভবত অগাস্টাস হিকি সাহেবের কাছ থেকে। হিকি সাহেব কলকাতায় প্রেস করেন ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে। আর এই প্রেস থেকে বের করতেন সাহেবসুবোদের কেচ্ছা কাহিনির কাগজ বেঙ্গল গেজেট পত্রিকা। ছাপা হত ইংরেজি ভাষায়। গঙ্গাকিশোর প্রথমে কলকাতার ১৪৫ নং চোর বাগান স্ট্রীটে প্রতিষ্ঠা করলেন বাঙ্গাল গেজেটি যন্ত্রালয়। এখান থেকেই ১৮১৮ খ্রি ১৫ই মে শুক্রবার বাঙ্গাল গেজেটি প্রকাশিত হয়। মাসিক চাঁদা নির্ধারিত হয়েছিল ২ টাকা।

    দুর্ভাগ্যবশত বেঙ্গল গেজেটির কোন কপি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। আর এই জন্যই সমাচার দর্পণকেই অনেকে বাংলা ভাষার আদি সংবাদপত্রের মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু ১৮১৮ খ্রি ১৪ ই মে প্রকাশিত, ১২ই মে তারিখ যুক্ত এবং উক্ত বছরের ৯ই জুলাইয়ে গভর্ণমেন্ট গেজেটে গঙ্গাকিশোরের সহযোগী হরচন্দ্র রায় যে দুটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিলেন সেখান থেকেই জানা যায় ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই মে শুক্রবার গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল বাঙ্গাল গেজিটি। আর মার্শম্যানের সম্পাদনায় সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়েছিল এর আট দিন পর অর্থাৎ ২৩ শে মে হুগলি জেলার শ্রীরামপুর থেকে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকরে বা লঙ সাহেবের ক্যাটালগেও বাঙ্গাল গেজেটিকে বাংলা ভাষার আদি সংবাদপত্র বলা হয়েছে।

    গঙ্গাকিশোরের সহযোগী হরচন্দ্র রায়ও ছিলেন বহড়াবাসী। একসময়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও বই ব্যবসার পার্টনার। কিন্তু উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ার ফলে গঙ্গাকিশোর কলকাতা থেকে প্রেস নিয়ে চলে আসেন স্বগ্রাম বহড়ায় ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে। এর প্রমাণ মেলে তদানীন্তন সরকারের কাছে গঙ্গাকিশোরের আবেদনের ভিত্তিতে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা এপ্রিল তারিখে কাউন্সিল চেম্বারে চিফ সেক্রেটারির স্বাক্ষর সম্বলিত আদেশনামাটি থেকে। সেখানে লেখা হয়েছে - "M.L.Bayley having submitted to Government Gangakeysore Bhattacharji's application to be permitted to carry with him to Buhurraw near Moorshidabad his Printing Press,has been authorised to inform Gangakeysore that Government are not aware of any objection to his carrying his intentions into effect".

    সরকারি আদেশপত্রে এই বহড়াকে মুর্শিদাবাদের সন্নিকটে বলার কারণ সম্ভবত নবাবি রাজধানী ছিল বলে। গঙ্গাকিশোর বহড়ার নিজ বাড়িতে প্রেস স্থাপন করে বই ছাপতে থাকেন। কলকাতাতেও বইয়ের দোকানটি ছিল নিঃসন্দেহে। বহড়া থেকেও একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেগুলি কলকাতায় বিক্রি হত। যে বইগুলি গঙ্গাকিশোরের কলকাতা ও বহড়া থেকে প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি হল - অন্নদামঙ্গল কাব্য(১৮১৬), এ গ্রামার ইন ইংলিশ এন্ড বেঙ্গলি। এই ব্যাকরণ বইটিও বেশ অভিনব। অর্থ উচ্চারণ সমেত প্রথম থেকে সাত বর্ণ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় তর্জমা রয়েছে। এছাড়া গণিত নামতা ব্যাকরণ লিখবার আদর্শ - এর সঙ্গে চামড়া বন্ধ জেলদা করা হিতোপদেশও ছাপা হয়েছিল। দাম ৩টাকা। এছাড়া দায়ভাগ(১৮১৬-১৭), চিকিৎসার্ণব(১৮২০), শ্রীমদ্ভাগবতগীতা(১৮২০), দ্রব্যগুণ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। অনেকেই বলেন বহড়া থেকে নাকি বাঙ্গাল গেজেটি-ও প্রকাশিত হত। তবে এর কোনও কপি পাওয়া যায়নি।

    বর্তমানে বহড়ার গঙ্গাকিশোরের ভিটে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভাঙাচোরা দেওয়াল আর জঙ্গলে মুখ ঢেকেছে সারা বাংলার সংবাদপীঠস্থান বহড়া। গঙ্গাকিশোর ছিলেন শিবভক্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেউলমন্দিরটিও লতাপাতায় মুখ ঢেকেছে। শুধুমাত্র ছাপাখানার ডাঙায় গঙ্গাকিশোরের স্মারকস্তম্ভটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নির্বাক ইতিহাসের মতো। যতবারই গঙ্গাকিশোরের ছাপাখানার ডাঙায় যাই ততবারই নিজের মনে প্রশ্ন জাগে-

    কলকাতাকে যিনি প্রথম বইমুখী করেছিলেন - বইয়ের ব্যবসাকে যিনি স্বাধীন ভাবে জীবিকার্জনের মাধ্যম করেছিলেন - গ্রন্থনগরী তিলোত্তমা মহানগরীর যিনি আদি কারিগর - সেই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য আর কত দিন ব্রাত্য রয়ে থাকবেন খোদ কলকাতাতেই? পাবলিসার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড আয়োজিত আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলাতেও কি প্রথম বাঙালি পাবলিশার গঙ্গাকিশোর পেয়েছেন তাঁর প্রাপ্য মর্যাদাটুকু? প্রশ্নগুলো ওঠার সময় এসেছে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @