No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মুঘল আমলে তৈরি বাংলার প্রথম বালাপোষ আর মুর্শিদাবাদের কারিগর আতির খানের পরম্পরা

    মুঘল আমলে তৈরি বাংলার প্রথম বালাপোষ আর মুর্শিদাবাদের কারিগর আতির খানের পরম্পরা

    Story image

    জও বাংলার শীতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে বালাপোষের নাম। কাপড়ের দুই পরতের মাঝে তুলো বসিয়ে তৈরি হয় বালাপোষ, যা গায়ে দিলে তুলো আর আতর মেশানো অপরূপ সুবাসে যে কারোর হৃদয় জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। বাংলার প্রথম বালাপোষটি তৈরি হয়েছিল মুর্শিদাবাদ জেলায় (Murshidabad), মুঘল আমলে। সে সময়ে সিংহাসনে বসে রয়েছেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সুজা-উদ-দিন। ১৮ শতকে সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছেছিল মুর্শিদাবাদ, হয়ে উঠেছিল উত্তর ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের সবচেয়ে বড়ো কেন্দ্র। তবে বহুল প্রচলিত গল্পটি বলে, বালাপোষের উদ্ভাবন হয়েছিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার রাজত্বকালে, যিনি সুজা-উদ-দিনের মৃত্যুর প্রায় ১৭ বছর পর সিংহাসনে বসেন।

    শীতকালে সাধারণত পশুর চামড়া ও উলের তৈরি যে রুক্ষ কম্বল ব্যবহার হত, তা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে তেমন আরামদায়ক বলে মনে হয়নি। তিনি শীত নিবারণের জন্য এমন কিছু চেয়েছিলেন যা একাধারে উষ্ণ ও আরামদায়ক হবে। যা ভরে থাকবে ফুলের গন্ধে, আর গায়ে জড়ালে মনে হবে, যেন প্রেয়সীর আলিঙ্গন! নবাবের ইচ্ছেনুরূপ কম্বলটি বানানোর দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন কারিগর আতির খান। তাঁর বহুদিনের প্রচেষ্টায় অবশেষে জন্ম হল বালাপোষের, যা গতানুগতিক কাঁথা, রাজাই কিংবা দোহারের চাইতে একেবারে আলাদা।

    শীতকালে সাধারণত পশুর চামড়া ও উলের তৈরি যে রুক্ষ কম্বল ব্যবহার হত, তা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে তেমন আরামদায়ক বলে মনে হয়নি। তিনি শীত নিবারণের জন্য এমন কিছু চেয়েছিলেন যা একাধারে উষ্ণ ও আরামদায়ক হবে।

    খাঁটি বালাপোষ তৈরির রহস্য গচ্ছিত রইল আতির খানের হৃদয়ে, বংশ পরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হতে লাগল। আজও বাংলার সবচাইতে খাঁটি বালাপোষ তৈরি হয় কেবল মুর্শিদাবাদে, অন্য কোথাওই আর খোঁজ করলে এ জিনিস মেলা ভার। কয়েক বছর আগে অবধি মুর্শিদাবাদের খাগড়া চৌরাস্তা, বড়ো মসজিদ লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা সাখাওয়াত হুসেন খান ছিলেন এই শিল্পের একমাত্র কারিগর। শোনা যায়, আতির খান নাকি সম্পর্কে ওঁর দাদুর বাবা ছিলেন। সাখাওয়াত হুসেন খানের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর বর্তমানে ওঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে সগর্বে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে।

    সাখাওয়াত হুসেন খানের জ্যেষ্ঠা কন্যা ববি বঙ্গদর্শন.কম-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, “বহু বছর ধরে বংশ পরম্পরায় আমরা বালাপোষ তৈরি করে চলেছি। আমার বাবাকে এই কাজ শিখিয়েছিলেন দাদু। বালাপোষ তৈরি ছাড়াও নানান হস্তশিল্পে দাদু অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। আমরা ভাইবোনেরা ছোটোবেলায় মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, কীভাবে নিপুণ কায়দায় যত্ন সহকারে বাবা একের পর এক বালাপোষ বুনে চলেন। এই কাজ কিন্তু মোটেই সহজ নয়। এর জন্যে নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হয়। বালাপোষ তৈরির শুরু থেকে শেষ অবধি কারিগর নিজেকে আটকে রাখেন একটি বন্ধ ঘরে, যেখানে জল পড়বার মতো সামান্য শব্দটুকুও ঢুকতে পারে না!”

    বালাপোষ তৈরিতে সব ধরনের তুলোর ব্যবহার চলে না। কারিগর নিজেই দক্ষ হাতে বেছে নেন উৎকৃষ্টমানের তুলো, যা তারপর সময় নিয়ে পরিশুদ্ধ করেন তাঁরা। প্রথমে এই তুলো হাতে করে ছেঁটে নিয়ে শুরু হয় ‘ভুনাই’-এর কাজ। ‘ভুনাই’-এর জন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্র থাকে, যার সাহায্যে কমপক্ষে কুড়ি থেকে পঁচিশবার পরিশুদ্ধ করা হয় তুলোটিকে। যত সময় এগোয়, তুলোর ওজন হালকা হয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ঘরময়। কেবলমাত্র ভুনাই করতেই পাঁচ থেকে ছয়দিন সময় লেগে যায়। তারপর দু-দিকে কাপড়ের পরত দিয়ে ভিতরে তুলোর দলাগুলি এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে শত টানা-হ্যাঁচড়া সত্ত্বেও তা জায়গামতোই আটকে থাকে।

    কয়েক বছর আগে অবধি মুর্শিদাবাদের খাগড়া চৌরাস্তা, বড়ো মসজিদ লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা সাখাওয়াত হুসেন খান ছিলেন এই শিল্পের একমাত্র কারিগর। শোনা যায়, আতির খান নাকি সম্পর্কে ওঁর দাদুর বাবা ছিলেন।

    “তুলো ভুনাইয়ের পর সমগ্র বালাপোষটি তৈরি হতে এক থেকে দুই সপ্তাহ মতন সময় লেগে যায়। আমরা সাধারণত বালাপোষে মলমল কাপড়ের পরত ব্যবহার করে থাকি। কেউ যদি আলাদা ভাবে সিল্কের বালাপোষ কেনবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, তখন বালাপোষের একপিঠে মলমলের বদলে সিল্কের কাপড় ব্যবহার করি আমরা।” জানান ববি। ক্রেতাদের বিশেষ অনুরোধে আতর দেওয়া সুগন্ধি বালাপোষও তৈরি করেন ওঁরা। এ প্রসঙ্গে ববি বলেন, “কোন আতর ব্যবহার করলে তা বহু বছর একই রকম সুগন্ধ ছড়াবে, সে কথাও বাবা বলে গিয়েছিলেন আমাদের। ফিরদৌস আতরের চাহিদা সবচাইতে বেশি। এছাড়াও সময় বিশেষে রুহ-গুলাব আতর ব্যবহার করি আমরা।” ক্রেতারা বালাপোষ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর যখন ফোনে জানান যে, সেটি খোলা মাত্র সারা ঘর আতরের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে, গর্বে বুক ভরে ওঠে ববির।

    তুলো ভুনাই থেকে শুরু করে তুলো বসানো, বালাপোষের দু-দিকের পরত সেলাই করা, তা বাজারজাত করা ও অর্ডার অনুযায়ী প্যাকিং করা সমস্ত প্রক্রিয়াটাই ববির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করে চলেছেন তাঁর দাদা ও বোন। বাজারে চাহিদা থাকলেও ববি বা ওঁর পরিবারের কাছে ততখানি মূলধন নেই যে তাঁরা সে চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিয়ে উঠতে পারবেন। ববি বলেন, “শীত থেকে রক্ষা করা ছাড়াও বাংলার বহু পুরোনো ঐতিহ্য বহন করে এই বালাপোষ। এই শিল্পের একটা নিজস্ব সম্মান রয়েছে, যার তুলনা কখনোই সাধারণ বাজারচলতি সিন্থেটিক লেপ-কম্বলের সঙ্গে করা চলে না। তাছাড়া, এগুলি তৈরি করতে যা মূলধন আর কায়িক শ্রম লাগে, সেসব মাথায় রেখে এগুলির বিক্রয় মূল্যও হয়ে দাঁড়ায় বেশ খানিকটা চড়া, যা সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।”

    তা সত্ত্বেও, কেবল এই অসামান্য শিল্পসৃষ্টিকে নিজের সংগ্রহে রাখবার জন্য পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে মানুষ তাঁদের কাছে আসে। এছাড়াও, স্থানীয় অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের পক্ষ থেকে প্রতি বছরই ধবধবে সাদা রঙের একটা বালাপোষ নেওয়া হয়। সম্প্রতি দ্য বেঙ্গল স্টোর (The Bengal Store) ব্র্যান্ড ফিরিয়ে এনেছে সেই উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বালাপোষ। নবাবী আমলে বালাপোষে ব্যবহৃত হত উন্নতমানের কার্পাস তুলো। দ্য বেঙ্গল স্টোর ফিরিয়ে এনেছে সেই কার্পাস তুলো আর সিল্কের কাপড়ে মোড়া নবাবী-বালাপোষ। দ্য বেঙ্গল স্টোর-এর ঠিকানা: ১২৭, যোধপুর পার্ক, কলকাতা ৭০০০৬৮ (সোমবার বাদে প্রতিদিন খোলা)।
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @