দেশে গরিবি সামাজিক স্থায়িত্বকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে

এর আগে গরিবি বুঝবার জন্য একটিই দারিদ্ররেখা ছিল, যারা দিনে ১.৯০ মার্কিন ডলার বা তারও কম খরচা করতে পারে, তাদের গরিব বলা হবে। এতে বিশ্বের দেশে দেশে গরিবি বোঝা যেত ঠিকই, কিন্তু মধ্যবিত্তের সংখ্যাটা ধরা যেত না। এই সমস্যাটা কাটাতে বিশ্ব ব্যাঙ্ক তিনটি দারিদ্র-রেখা চালু করেছে। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে এই পদ্ধতিতে তথ্য প্রকাশ করাও শুরু করেছে তারা। আর এই তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, কী ভয়ানক অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এই দেশ।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের দারিদ্র-রেখা
এখন আরও দুটো রেখা এলো। প্রথমটি নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য, ৩.২০ মার্কিন ডলার, আর অপরটি মধ্যবিত্তদের জন্য, ৫.৫০ ডলার। অর্থাৎ, যারা দিনে ১.৯০ মার্কিন ডলারের সমান বা কম খরচা করতে পারে, তারা চরম গরিব। যারা প্রতিদিন গড়ে ১.৯০ মার্কিন ডলারের বেশি কিন্তু ৩.২০ মার্কিন ডলারের কম খরচা করে, তারা নিম্ন মধ্যবিত্ত। আর যারা প্রতিদিন গড়ে ৩.২০ মার্কিন ডলারের বেশি কিন্তু ৫.৫০ মার্কিন ডলারের সমান বা কম খরচ করে তারা মধ্যবিত্ত। এর ওপরে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনী সম্প্রদায়। সাধারণভাবে আমরা ডলার দেখলে তাতে কত টাকা হয়, সেই হিসেবটা করে ফেলি। যেমন ধরুন, এখন মুদ্রা বাজারে এক মার্কিন ডলারের মূল্য প্রায় ৬৪.৭০ টাকা। তাহলে ১.৯০ মার্কিন ডলারের টাকায় দাম হলো প্রায় ১২৩ টাকা, ৩.২০ মার্কিন ডলারের দাম ২০৭ টাকা ও ৫.৫০ মার্কিন ডলারের দাম প্রায় ৩৫৬ টাকা। কেউ ভাবতে পারেন, দিনে ১২৩ টাকার কম খরচা করলে যদি গরিব বলে ধরা হয়, আমাদের দেশে তো তেমন বহু কোটি লোক আছে। প্রতিদিন পাঁচ জনের একটি পরিবার ১২৩ x ৫ = ৬১৫ টাকা খরচা করাটা তো ভালোই। এখানেই একটা বোঝার ভুল আছে।
পারচেসিং পাওয়ার প্যারিটি বা মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার তুলনা
বিশ্ব ব্যাঙ্ক যখন এই হিসেব করে, তখন মুদ্রা বাজারে মুদ্রার বিনিময় মূল্য ধরে করে না। তাদের হিসেবের মাপকাঠি হলো ওই পরিমাণ মুদ্রায় কত জিনিস পাওয়া যায়। যেমন ধরুন, নিউ ইয়র্কে এক লিটার দুধের দাম হতে পারে ২ ডলার। ২ মার্কিন ডলারের টাকায় দাম প্রায় ১২৯ টাকা। সেই হিসেবে আমাদের কলকাতায় কি এক লিটার দুধের দাম ১২৯ টাকা লাগে? না লাগে না, ধরা যাক কলকাতায় এক লিটার দুধের জন্য দিতে হয় ৪০ টাকা। তাহলে এই হিসেবে এক ডলারের দাম হলো ২০ টাকা। এটাকেই পারচেসিং পাওয়ার প্যারিটি বা পিপিপি বলে। আরও একটু সহজ করে বললে, এক ডলারে মার্কিন দেশে যত জিনিস পাওয়া যায়, সেটা কিনতে কোনও দেশে যত মুদ্রা লাগে, সেটাই ওই দুই দেশের মধ্যে পিপিপি। এটা কিন্তু হিসেব করা মোটেই সহজ নয়, দুটি দেশের বহু পণ্যের তুলনামূলক দাম দেখে লম্বা-চওড়া অঙ্ক কষে এটা পাওয়া যায়। ওই হিসেব মতে এক মার্কিন ডলারের দাম ২০১৬ সালে ছিল ১৭ টাকা ৪৫ পয়সা। এই ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গেলে অন্যান্য অনেক দেশের সম্পর্কেও এই তথ্য মিলবে, যেমন মার্কিন ডলার ও ব্রিটিশ পাউন্ডের তুলনা। আরও একটি আকর্ষক জিনিস এই তথ্যে দেখা যায়। এক মার্কিন ডলারের ক্রয়ক্ষমতার সমান ১৯৯০ সালে ছিল ০.৬৪ ব্রিটিশ পাউন্ড, ২০১৬ সালে ০.৬৯ ব্রিটিশ পাউন্ড, সামান্য বেড়েছে। ভারতে কিন্তু চিত্রটা আলাদা। এখানে ১৯৯০ সালে ছিল ৫ টাকা ৭৬ পয়সা, ২০১৬ সালে হয়েছে ১৭ টাকা ৪৫ পয়সা। অর্থাৎ তিনগুণ বেড়েছে, তার মানে মার্কিন দেশের তুলনায় ভারতে জিনিসপত্রের দাম তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই হিসেব অনুযায়ী ১.৯০ মার্কিন ডলারের সমমানের টাকা হলো প্রায় ৩৩ টাকা, ৩.২০ মার্কিন ডলারের দাম প্রায় ৫৬ টাকা আর ৫.৫০ মার্কিন ডলারের সমমূল্য প্রায় ৯৬ টাকা। এটাকেই সঠিক তুলনামূলক হিসেব বলে ধরা হয়।
ভারতে চরম দারিদ্র
বর্তমানে ভারতে ২৬ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ চরম গরিবিতে দিন কাটায়। এদের দৈনিক খরচের ক্ষমতা ৩৩ টাকা বা তারও কম। ভারতের জনসংখ্যার ২১ শতাংশ এরা। সারা পৃথিবীতে এরকম মানুষ আছে প্রায় ৯৬ কোটি, তার ২৮ শতাংশ এ দেশে থাকে। আমরা এই ব্যাপারে চিনের সঙ্গে একটা তুলনা করতে করতে যাব, কারণ দুটি দেশ প্রায় একই সময়ে স্বাধীনতা ও প্রজাতন্ত্র পেয়েছে, ভারত ১৯৪৭ সালে ও চিন ১৯৪৯ সালে। দুটি দেশই জনবহুল ও স্বাধীনতার সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ চরম গরিব ছিল। বর্তমানে চিনে ওই ১.৯০ মার্কিন ডলারের কম খরচ করে, এমন মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৬০ লক্ষ, যা চিনের নিজস্ব জনসংখ্যার ৮ শতাংশ, পৃথিবীর এমন মানুষদের ১১ শতাংশ।
ভারতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত
যারা দিনে ৩৩ টাকার বেশি কিন্তু ৫৬ টাকার কম খরচ করে, তাদের সংখ্যা ভারতে ৪৯ কোটি ৫০ লক্ষ। চিনের ক্ষেত্রে ওই সংখ্যাটা হলো ২১ কোটি মানুষ। চরম গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মিলিত সংখ্যা ভারতে ৭৬ কোটি ৩০ লক্ষ (পৃথিবীর ৩৩ শতাংশ) আর চিনে ৩১ কোটি ৬০ লক্ষ (পৃথিবীর ১৪ শতাংশ)।
যাদের দৈনিক খরচ ৫৬ টাকার বেশি কিন্ত ৯৬ টাকার বেশি নয়, তাদের সংখ্যা ভারতে ৩৩ কোটি ৭০ লক্ষ, চিনে ৩৪ কোটি ৫০ লক্ষ। দিনে ৯৬ টাকা বা তার কম মাথাপিছু খরচ, এমন মানুষের সংখ্যা তাহলে দাঁড়াল ১১০ কোটি, যা ভারতের জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ (ভারতে এখন জনসংখ্য প্রায় ১৩৪ কোটি, চিনে ১৩৮ কোটি ও সারা পৃথিবীতে ৭৬০ কোটি)। পাঠক লক্ষ করবেন, দিনে ৯৬ টাকার বেশি খরচ করেন এ দেশের মাত্র ১৩ শতাংশ লোক। সারা পৃথিবীর হিসেব ধরলে ৯৬ টাকা বা তার কম খরচ করনেওয়ালা লোকের ৩০ শতাংশই ভারতে থাকে। চিনে ৫.৫০ মার্কিন ডলারের সমান বা কম দৈনিক খরচের লোক আছে ৬৬ কোটি ১০ লক্ষ, যা ওই দেশের জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ। দেখুন, চিনের ৫১ শতাংশ মানুষই দিনে ৫.৫০ মার্কিন ডলারের বেশি খরচ করে। চিনে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও চরম গরিবের মিলিত সংখ্যাটা সারা পৃথিবীর এমন মানুষের ১৮ শতাংশ।
ভারতে সম্পদ চরম কেন্দ্রীভূত
ভারতে সবথেকে ধনী ১ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৫৮.৪ শতাংশ। আর ধনী ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের সম্পদের ৮০.৭ শতাংশ। এই কুৎসিত বৈষম্য মোদিবাবুর আমলে রকেট গতিতে বাড়ছে। সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন দারুণ দারুণ ভাষণ ও শ্লোগান, আর আদানি-আম্বানিরা তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেশের সব ক্ষীর-ননীটুকু। ভয় হয়, সামাজিক যে স্থিরতা স্বাধীনতার পর থেকে আজও রয়েছে, তা বিঘ্নিত হবে না তো?