No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কেবল সীতাভোগ এবং মিহিদানাই নয়, বর্ধমান জেলা জনপ্রিয় ছিল খাস ব্রিটিশ স্টুয়ের স্বাদেও

    কেবল সীতাভোগ এবং মিহিদানাই নয়, বর্ধমান জেলা জনপ্রিয় ছিল খাস ব্রিটিশ স্টুয়ের স্বাদেও

    Story image

    ট্রেনের কামরা বর্ধমান (Bardhaman) স্টেশন ছুঁলেই চোখে পড়ে, থরে থরে সাজানো মিষ্টির দোকান। বর্ধমান শহরের জগৎজোড়া পরিচিতির অন্তরালে নিঃসন্দেহেই রয়েছে মিষ্টির গল্প। বিখ্যাত সীতাভোগ (Sitabhog) এবং মিহিদানার (Mihidana) রসায়ন। কিন্তু মিষ্টিমুখেই কি কেবল পরিচয় এ শহরের? না। মন্দির, তীর্থস্থান এবং স্থাপত্যে ঘেরা এ শহরের ঐতিহ্যে রয়েছে আরও নানান কিছু। এই শহরে নামে রয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে তৈরি এক আইরিশ খাবার। নাম ‘বর্ধমান স্টু’ (Bardhaman Stew)। মাছ, মাংস ও মদিরা সহযোগে তৈরি এই খাবার ব্রিটিশ আমল থেকেই বেশ জনপ্রিয়।

    রান্নার জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল রূপোর বাসন। বলা হত, স্টুয়ের স্বাদ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল রূপোর পাত্রের উপরেই।

    বর্ধমান স্টু-এর নামকরন সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য জানা না গেলেও, ১৮ শতকের শেষ থেকেই বহু ব্রিটিশ পর্যটকের লেখনিতে উঠে এসেছে এই খাবারের নাম। ব্রিটিশ আধিকারিক তথা শিল্পী স্যার চার্লস ডি’ওয়েলির ‘টমর দ্য গ্রিফিন’ নামক প্যারোডি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮২৮ সালে। সেখানে এই আইরিশ খাবারকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ‘অত্যন্ত দামি টিফিন’ বলে উল্লেখ করেছেন লেখক। ঐতিহাসিক ওয়াল্টার কে ফিরমিঙ্গারের ‘থ্যাকারস গাইড টু ক্যালকাটা’, এলিজা ফে’র ‘অরিজিনাল লেটারর্স টু ইন্ডিয়া’ এবং সাংবাদিক ক্রিস্টিয়ান ইসোবেল জনস্টনের ‘দ্য কুক অ্যান্ড হাউজওয়াইফস ম্যানুয়াল’-এও ‘বর্ধমান স্টু’র কথা রয়েছে। একথা সত্যই যে খবারের গল্প নিয়ে বইয়ের এ তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। তবে এর জনপ্রিয়তা কীভাবে তুঙ্গে উঠেছিল সে কাহিনির বর্ণনা রয়েছে এনাবেল লয়েড Picnic Crumbs বইটিতে। তিনি এই বইয়ে লেখেন, কলকাতা থেকে ৬৭ মাইল দূরে অবস্থিত এই বর্ধমান শহরটিই ছিল ব্রিটিশ ভারতের জেলা সদর। এখানে যেসমস্ত রাজকর্মচারী এবং সৈন্যরা থাকতেন, তাঁদের মধ্যেই প্রথম দিকে এই বর্ধমান স্টু-এর জনপ্রিয়তা অধিক ছিল। পরবর্তীকালে তাঁরা কাজের সূত্রে কলকাতা এবং কলকাতা (Kolkata) সংলগ্ন এলাকায় গেলে সঙ্গে করে নিয়ে যান তাঁদের প্রিয় স্টু-টিকেও। তারপর অবশ্য আর বেশি সময় লাগেনি, বাঙালির খাদ্যপ্রেমের সহায়তায় ক্রমেই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যায় বর্ধমান স্টু।

    ভিনদেশি এই স্টুয়ের নাম কেন বর্ধমান, তা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। তবে এর অসামান্য স্বাদ-গন্ধ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। স্টুয়ের উপাদানে তো বটেই, রান্নার কৌশলেও রয়েছে আভিজাত্য। শোনা যায়, রুপোর কড়াইয়ে না রাঁধলে নাকি কৌলিন্য থাকে না রান্নার! এমনিতেই সহজপাচ্য উপরন্তু  রান্না এবং গরম করার সুবিধা। শোনা যায়, সেই সময়ে অনেকেই নাকি সামান্য স্পিরিট ল্যাম্পের আঁচেও স্টু গরম করে নিতেন। এছাড়াও যে কোনো প্রতিকূল অবস্থাতেও অতি সহজেই একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সহজ ছিল, তাই খুব দ্রুত অন্য খাবারকে টেক্কা দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বর্ধমান স্টু। রান্নার জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল রূপোর বাসন। বলা হত, স্টুয়ের স্বাদ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল রূপোর পাত্রের উপরেই।

    সেইসময় দাঁড়িয়ে বর্ধমান-স্টু একটি ফিউশন জাতীয় খাবার হিসাবে মর্যাদা লাভের দাবি রাখে। প্রথমে মাংস সেদ্ধ করে নিয়ে তা টুকরো করে কেটে পাত্রে রাখা হত। তাঁর সঙ্গে মেশানো হতো পরিমাণ মতো আঙ্কোভি এসেন্স, মদিরা, জল, ময়দা, মাখন, টুকরো পেঁয়াজ এবং গোলমরিচ। পেঁয়াজ নরম হয়ে যাওয়া পর্যন্ত হালকা আঁচে রুপোর পাত্রে জমিয়ে রান্না করা হত এই বিখ্যাত স্টু’টি। অবশেষে লেবুর আচার অথবা রস সহযোগে পরিবেশন করা হত কুলীন বর্ধমান স্টু।

    যদিও সময় চিরকাল যে সবার সমান থাকে না তা বোঝা যায় আজকের দিনে বর্ধমান স্টু-এর অস্তিত্ব সংকট দেখেই। উনিশ শতকের পরে ইউরোপিয়ানরা আরও ভিন্ন স্বাদের স্টু-এর সঙ্গে পরিচিতি লাভ করতে থাকলে, বর্ধমান-স্টু তার নিজের জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং ক্রমে তার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু ১৮ শতকের বাংলায় দাঁড়িয়ে যে ‘বর্ধমান স্টু’র বিকল্প ছিল না ব্রিটিশ স্বাদের ঘরানায়। একদিকে পশ্চিমের খাদ্যাভ্যাসের ছোঁয়া আবার অন্য দিকে ছিল প্রাচ্যের নানান মশলার সমাহার, জনপ্রিয় স্বাদের রহস্য লুকিয়ে ছিল অনবদ্য এই ফিউশনেই।

     

    তথ্যসূত্র –

    ১. www.theoldfoodie.com
    ২. Scroll.in
    ৩. www.getbengal.com

    ৪. বর্তমান পত্রিকা

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @