দুই নারীর অকপট আত্মকথন

১
আমার জীবন/ রাসসুন্দরী দাসী/ বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত/ ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া/ প্রথম প্রকাশ( NBT) ২০০৮।
এ এমন এক গ্রন্থ যার প্রস্তাবনা রচনা করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আর গ্রন্থপরিচয় দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের লেখা। এই গ্রন্থের সাথে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও বুঝি ধৃষ্টতা।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থখানি ...৮৮ বৎসরের একজন বর্ষীয়সী প্রাচীন রমণীর লেখা। …তখনকার কালে স্ত্রীলোকের লেখাপড়া শেখা দোষের মধ্যে গণ্য হইত।’ সন্দেহ কী যে তাঁকে বহু কষ্টে লেখাপড়া শিখতে হয়েছিল। তবে, সম্পাদক বারিদবরণ ঘোষ মহাশয় জানাচ্ছেন, ১৮৭৬ সালে যখন তাঁর বই প্রথম ছাপা হয় তখন লেখিকার বয়স ৬৭। আসলে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে প্রস্তাবনা লেখেন তা যুক্ত হয় বইটির তৃতীয় সংস্করণে, ১৯০৬ সালে। রাসসুন্দরী মারা যান ১৮৯৯ সালে।
দীনেশচন্দ্র লিখেছেন, “‘আমার জীবন’ পুস্তকখানি শুধু রাসসুন্দরীর কথা নহে, উহা সেকেলে হিন্দু রমণীগণের সকলের কথা; এই চিত্রের মত যথাযথ ও অকপট মহিলা-চিত্র আমাদের বাঙ্গালা সাহিত্যে আর নাই।”
কেমন সেকাল?
‘সেকেলে রমণী সমাজের সম্পূর্ণ বশ্য ছিলেন। … বধূবেশী হিন্দু রমণী সহিষ্ণুতা ও ত্যাগশীলতার একখানি মৌন ছবিবিশেষ ছিলেন।’ (দীনেশচন্দ্র)।
একালে কি ছবিটা খুব বদলেছে?
সম্পাদক কয়েকটি জরুরি তথ্য জানিয়ছেন। ‘বাংলা সাহিত্যে প্রথম আত্মজীবনীটি রাসসুন্দরী দাসীর লেখা। … রাসসুন্দরীর জন্ম ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে। তখনও রামমোহন কলকাতায় আসেননি, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা বিদ্যাসাগরের জন্মই হয়নি’।
ওদিকে দীনেশচন্দ্র জানাচ্ছেন যে, ‘অমরকোষে রমণীর আর একটি প্রতিশব্দ ‘ভীরু’।’ এমন অর্থ তো আমাদের সমাজই সৃষ্টি করেছে। কিন্তু, আর কতকাল এই বোঝা বইবে এই সমাজ? নারীমুক্তি চাই যদি তবে আমাদের সকলেরই দায় থাকে রমণীর অর্থ ‘ভীরু’ এই অপবাদ থেকে তাঁদের মুক্ত হবার উদ্যোগে পাশে থাকা।
আরও একটি কথা – প্রকাশকের দাবি, “ঊনিশ শতকে কোনো বাঙালী অবগুন্ঠনবতী নারীর লেখা আত্মজীবনী ভারতীয় সাহিত্যে দ্বিতীয় রহিত।” এই দাবি সত্য।
২
শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত/ মানদা দেবী/ প্রথম চিরায়ত সংস্করণ জানুয়ারি ২০০৪/ সম্পাদনাঃ ইরাবান বসুরায়
‘আমার কৈফিয়ত’ তথা আলোচ্য বইটির ভূমিকায় লেখিকা, মানদা দেবী, লিখেছেনঃ
‘আমার জীবন মোটেই মহৎ নহে, ...বারবনিতা-জীবনে যে দুঃখ কষ্ট এবং অনুতাপ ভোগ করিয়াছি তাহারই স্মৃতি লইয়া এই পুস্তক রচিত হইয়াছে।’
তবু, তিনি আরও বলেছেন, ‘যে সকল সাধু-বেশী লম্পট আমাদের সংস্পর্শে থাকিয়াও সমাজের উচ্চস্থান অধিকার করিয়া আছেন, ...এই ভন্ডের দল কী প্রকারে অবোধ বালিকার সর্বনাশ করে, তাহার চিত্র দেখিয়া স্তম্ভিত হইবেন।’
এভাবে তিনি স্পষ্ট করেছেন, পূর্ণ সামাজিক চিত্র পেতে এই ধরনের জীবনী গ্রন্থের গুরুত্ব।
কিন্তু কে এই মানদা দেবী?
আরও পড়ুন
তুলি তো আগুনের মতো হবেই …
সম্পাদক শ্রী ইরাবান বসুরায় লিখেছেন, ‘ব্যক্তির এই আত্মপরিচয় সন্ধান ...নারীর নিজস্বতার সন্ধান।’ তিনি আরও বলেছেন যে, ‘মানদা নিজে অসুস্থ জীবনযাপন করলেও, কোনো কপটতা করেননি তাঁর আচরণ ও প্রবৃত্তি সম্পর্কে, কিন্তু সমাজে যারা মান্য বলে পরিচিত তাঁদের গোপন কার্যকলাপ তাঁকে একধরনের বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা দিয়েছে।’
মানদা দেবীর জন্ম ১৯০০ সালে সেকালের এক স্বচ্ছল সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে। বেথুন স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। এই গ্রন্থ রচনাকালে তাঁর বয়স মাত্র ২৯। নামটি আসল নয়, ছদ্ম। তাঁর ইচ্ছে ছিল প্রকৃত নাম ও ছবি প্রকাশের, কিন্তু অভিজ্ঞজনের অনুরোধে বিরত হন।
আত্মগ্লানি আর প্রবঞ্চিত হবার কাহিনি ছড়িয়ে আছে এই বইটির পাতায় পাতায়, কিন্তু নেই অশ্লীলতা, নেই ঘৃণার ক্লেদ। একদল মানুষ সে আমলে এই বইটি বাজেয়াপ্ত করার দাবি তুলেছিল, যদিও সে দাবি সামাজিক সমর্থনলাভে সক্ষম হয়নি। ভাগ্যিস!
মানদা দেবীর আরও ইচ্ছা ছিল ‘ভোটে পতিতার স্থান’ নামক একটি অধ্যায় যোগ করার, লেখাও ছিল – তবু, ‘বিশিষ্ট রাজনৈতিকের মতামত গ্রহণ না করিতে পারায়’ তা ছাপানো হয়নি (কিন্তু, গেল কোথায় সেই লেখা অংশটি? আর, বিশিষ্ট রাজনৈতিকের মতামত বলতে মানদা দেবী কী বোঝাতে চেয়েছিলেন?)। পুরুষশাসিত সমাজের কর্তাদের ভন্ডামি তিনি দেখেছেন, সয়েছেন পুরুষ প্রেমিকের ছলনা তাও আত্মপ্রচার বা গায়ের ঝাল মেটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, কাদা ছেটাতে নয়, এই জীবনী মানদা লিখেছেন সে আমলের ‘সমাজপতিদের মনোযোগ আকর্ষণ’ করতে। তাঁর এই দর্শনই এই গ্রন্থটিকে অনন্যতা দিয়েছে। মানদার সারল্য দিয়েছে পাঠযোগ্যতা। এই সেই বই যা পড়তেই হয় নিজেকে এবং নিজের দেশ-কালকে জানতে ও চিনতে।