No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    একশো অতিক্রান্ত দার্জিলিংয়ের চক বাজার আজও ধারণ করে আছে পাহাড়ি সংস্কৃতিকে

    একশো অতিক্রান্ত দার্জিলিংয়ের চক বাজার আজও ধারণ করে আছে পাহাড়ি সংস্কৃতিকে

    Story image

    র পাঁচটা বাজারের থেকে দার্জিলিং (Darjeeling)-এ বৃহস্পতিবারের চক বাজারের চেহারা চরিত্র অন্যরকম। লেপচা, তামাং, নেপালি, ভুটিয়া, খাস, গোরখা, রাই, নানা জনজাতি তাদের সংস্কৃতি, খাদ্যরীতি, জীবন-যাপন, ধর্ম বিশ্বাসের ডালি সাজিয়ে বসে স্বাগত জানান ঘুরতে আসা অতিথিদের। যার ফলে স্থানীয় মানুষদের শিল্প-কৃষিকাজ-জীবন যাপন-সংস্কৃতিকে অনুভব করা যায় গরম গরম খাবার খেতে খেতে। সমতলের মানুষেরা পরিচিতি পায় পাহাড়ি সংস্কৃতির আর বিভিন্ন পাহাড়ের জনজাতির মানুষের মধ্যে চলে নিজেদের আদানপ্রদান। এই বাজার বসে এমন দিনে যেদিন রোজের বাজার বন্ধ থাকে। তাই প্রতি বৃহস্পতিবার যখন দার্জিলিংয়ের সব বাজার বন্ধ থাকে সেই দিন স্থানীয় মানুষরা চক বাজার-এ পসরা সাজান। আর একত্রিত হয়ে উদযাপন করেন নিজেদের সংস্কৃতি। বিভিন্ন জন-জাতির মধ্যে রয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, মতের বৈষম্য, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা; তা হলেও বৃহস্পতিবারের এই বাজারে সবাই যেন বিবাদ ভুলে, বিভেদ ভুলে মিলন মেলা বসায়। অতিথিদের কাছে আসে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের বন্ধন বার্তা। গানে-নাচে-খাবারে নানা ধরনের উপাদানের পরিচিতিতে মেতে ওঠে বাজার, সময় গড়াবার সঙ্গে সঙ্গে। উদযাপন করেন নিজেদের সংস্কৃতিকে। শুধুমাত্র বাইরে থেকে আসা ট্যুরিস্ট নয়, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও স্বাদ নেয় এই দার্জিলিংয়ের চক বাজার-এর মিলন মেলায়।

    আজও চক বাজারে ঢুকলেই দেখা যায় নেপালি মহিলারা চালের গুড়ো, দুধ, চিনি, গরম মশলা দিয়ে তৈরি করেন শেল রুটি। আর সেই রুটি জিলিপির মতো এক প্যাঁচ দিয়ে তেলে গরম গরম পরিবেশন করা হয় ঘুরতে আসা মানুষের কাছে।

    স্থানীয় মানুষদের কথায়, ১৯২০ সালে দার্জিলিংয়ের চক বাজার স্থাপিত হয়। এই জায়গা তখন থেকেই ছিল ঘুরতে আসা মানুষের মিলনস্থল। আর বিভিন্ন জনজাতি তাদের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র ও গানের মাধ্যমে নতুন মানুষদের স্বাগত জানাতেন এখানে। সেই ঐতিহ্য আজও বহমান। বেড়াতে আসা মানুষের আপ্যায়নের গানের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হল স্থানীয় খাবারের স্বাদ। তাই আজও এই বাজারে ঢুকলেই দেখা যায় নেপালি মহিলারা চালের গুড়ো, দুধ, চিনি, গরম মশলা দিয়ে তৈরি করেন শেল রুটি। আর সেই রুটি জিলিপির মতো এক প্যাঁচ দিয়ে তেলে গরম গরম পরিবেশন করা হয় ঘুরতে আসা মানুষের কাছে।

    বাজারের অন্য পাশে তামাং উপজাতির মানুষেরা পরিবেশন করেন নিজেদের ক্ষেতের টাটকা রাই শাকের বড়া, আলুর বড়া, সবুজ রঙের রাই মোমো, পেঁয়াজি। সঙ্গে দিয়ে দেন ঘরে তৈরি গাছ টমেটো ও ডোলো লঙ্কার চাটনি। কাগজ বা প্লাস্টিকের প্লেটে নয়, এই প্লেট ওরা তৈরি করেন পাহাড়ি গাছের পাতা মুড়ে। এছাড়া তামাং উপজাতির শুকনো রাই শাকের গুন্দ্রু, শুকনো মুলোর সিংকি, বর্ষাকালের ঝরনার জলে ধরা শুকনো ছোটো মাছের সিদ্রা এই বাজারের উপাদেয় খাবার। সেই সঙ্গে দেখা যায় লেপচা আর তামাং উপজাতির মানুষেরা এই বাজারে নিয়ে আসেন ঠাকুমাদের তৈরি ট্র্যাডিশনাল আচার, রুটি ও চাউমিন।

    মজার কথা হল, এই বাজারে খাবারের পাশাপাশি শরীর সুস্থ রাখার জন্য পাহাড়ি ভেষজ ওষুধের দোকানও বসে। আর সেই ওষুধের দোকান বসান বৌদ্ধ সাধুরা।

    গোরখা খাবারের দোকানি পশরা সাজিয়েছেন নানারকম মাংসের তৈরি খাবার নিয়ে। কিমার তরকারি, স্যান্ডউইচ, ফ্যাট ফ্রাইয়ের মতো লোভনীয় খাবার এনে থাকেন উপজাতিরা। এইভাবেই পাহাড়ি উপজাতিদের কেউ নিয়ে আসেন হাতে বানানো মশলা আবার কেউ নিয়ে হাজির হন পাহাড়ের নানা গাছের ছাল-পাতার তৈরি ভেষজ আচার, কোয়াশ, কোয়াশ গাছের রুট, পাইন গাছের শুকনো ডাল, গাছ টমেটো, পাইন ফরেস্ট থেকে পাওয়া মাশরুম, অ্যাভোগাডো, কমলালেবু, অর্গ্যানিক মুরগি, ডিম, শুয়োর, হাঁস। সঙ্গে ছোটোদের জন্য গুড়ের পাকে তৈরি করা ভুট্টার পপকর্ণের মোয়া, লোপচু প্যারা, বাদাম চাক ইত্যাদিও নিয়ে আসেন পাহাড়ের মানুষেরা এই বাজারে।

     

    এখানে বসবাসকারি তিব্বতি দেশের মানুষজন আবার গৃহপালিত পশু ইয়াকের দুধের তৈরি চকোলেটের দোকান লাগিয়ে বসেন এখানে। সব মিলিয়ে পাহাড়ি খাদ্য সংস্কৃতির একটা পরিচয় মেলে। এই সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে যায় পাহাড়ি ঝরনা, পাইনের বন আর পরিচয় মেলে নানা ধরনের পাহাড়ি উপজাতির মানুষের পছন্দের খাদ্য তালিকার।

    মজার কথা হল, এই বাজারে খাবারের পাশাপাশি শরীর সুস্থ রাখার জন্য পাহাড়ি ভেষজ ওষুধের দোকানও বসে। আর সেই ওষুধের দোকান বসান বৌদ্ধ সাধুরা। তবে শুধু মানুষের জন্যেই নয়, গৃহপালিত পশুদের সুস্থ রাখার জন্যে তারা নিয়ে আসেন বিশেষ ধরনের পাহাড়ি ফল টোডি।

    এছাড়া এই বাজারেই দেখা যায় পাহাড়ি মহিলারা বসে বসে উলবোনার কাজ করছেন ক্রুশ কাঁটা দিয়ে। কেউ উল দিয়ে বুনছেন পাহাড়ি ফুলের ডালি কেউ বা আবার নিজেদের ট্রাডিশনাল পোশাক বিক্রি করছেন। আবার দার্জিলিংয়ের জাম্বোনি থেকে কেউ নিয়ে এসেছেন ধান গাছের তৈরি বিশেষ ধরনের মাদুর। ওঁদের মতে অর্শ রোগীদের একটু যন্ত্রণার উপশম হয় এই ম্যাটে বসলে। সঙ্গে পশমের তৈরি কোট, ব্যাগ এসব তো থাকেই। এককথায় এই বাজার হল পাহাড়ি জনজাতির সংস্কৃতির মুখ বা সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়।
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @