No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাস যাত্রায় লন্ডন থেকে কলকাতা, ছুঁয়ে আসত শ’দেড়েক দেশের সীমান্ত

    বাস যাত্রায় লন্ডন থেকে কলকাতা, ছুঁয়ে আসত শ’দেড়েক দেশের সীমান্ত

    Story image

    ক বাসে লন্ডন থেকে কলকাতা যাত্রা! তাও আবার সেই পঞ্চাশের দশকে। শুনতে বেশ চমকপ্রদ লাগছে নিশ্চয়ই? পৃথিবীর এই দীর্ঘতম বাস রুট যখন ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল, তখনও মানুষের এমনই মনে হয়েছিল। সম্প্রতি কিছু ছবি সেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের স্মৃতিকে উস্কে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে তুলে আনছে কিছু প্রশ্ন, এমনকি সন্দেহও। গত বছর থেকেই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছিল একটি ছবি। ছবিতে দেখা গিয়েছে, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনে যাত্রী বোঝাই একটি বাসকে। সেই বাসের যাত্রীরা প্রত্যেকেই রওনা হয়েছেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। ছবিটার সত্যতা প্রমাণের জন্য সেই বাসের একটি বিজ্ঞাপনও সম্প্রতি জনসমক্ষে এসেছে।

    ডবল ডেকার এই বাসটির নাম ছিল ‘অ্যালবার্ট’। সুদূর লন্ডন থেকে কলকাতা পর্যন্ত ছিল ‘অ্যালবার্ট ট্যুর সার্ভিস’-এর যাত্রাপথ। ১৯৫৭ সালের ১৫ এপ্রিল প্রথম লন্ডনের মাটি থেকে চাকা গড়ায় বিশ্বের দীর্ঘতম রুটের এই বাস। মাত্র ২০ জন যাত্রীকে নিয়ে লন্ডন থেকে কলকাতা রওনা হয় বাসটি, আর ফেরার সময় ছিলেন তাঁদেরই সাতজন (দুই মহিলা এবং পাঁচজন পুরুষ)। টিকিটের মূল্য? সেও নেহাত কম ছিল না। লন্ডন থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে লাগতো ৮৫ পাউন্ড আর ফেরার সময়ে এই ভাড়া ছিল ৬৫ পাউন্ড। জানা যায়, প্রায় ৫০দিন সময় লেগেছিল ‘অ্যালবার্ট’-এর কলকাতা পৌঁছাতে। লন্ডন থেকে প্রথমে বেলজিয়াম, যুগোস্লাভিয়া হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারত হয়ে কলকাতা, এই ছিল এই বাসের ‘হিপি রুট’ জার্নি। ১৯৭৬ পর্যন্ত টিকে থাকা এই দীর্ঘ ৭৯৯৭ কিলোমিটার বাসযাত্রায় থাকা, খাওয়া সংক্রান্ত সমস্ত ব্যবস্থাই বহাল ছিল।

    লন্ডন থেকে কলকাতাগামী এই বাসটি প্রথমে ইংল্যান্ড থেকে বেলজিয়াম এবং সেখান থেকে একে একে পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত হয়ে ভারতে প্রবেশ করতো। ভারতে প্রবেশের পর অ্যালবার্ট নয়াদিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ এবং বেনারস হয়ে অবশেষে কলকাতায় পৌঁছে যাত্রা শেষ করত। কলকাতা, লন্ডন এবং সিডনি জুড়ে অ্যালবার্টের যাতায়াতের জন্য একটি বছরব্যাপী সময়সূচীও তৈরি করা হয়েছিল সেই সময়। সেইমতো ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ এবং ৯ নম্বরের ট্রিপগুলি চলতো লন্ডন থেকে সিডনি পর্যন্ত আর ১২ থেকে ১৫ নম্বরের ট্রিপগুলির যাত্রা শেষ হতো কলকাতাতেই।

    এহেন অ্যালবার্ট যাত্রার বিলাসবহুল ঐশ্বর্যপূর্ণ পরিবেশ ছিল যেন অবিকল সেই ব্রিটিশদের আরএমএস ‘টাইটানিক’-এর মতোই কোনও এক ‘ড্রিম শিপ’। এই অ্যালবার্ট ট্যুরের তৎকালীন একটি বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, “বাসের মধ্যেই পাবেন যাত্রার স্বাধীনতা। হোটেল, ক্যাম্পসাইট, প্রতিকূল আবহাওয়া - সবকিছু থেকেই স্বাধীনতা।” এই অ্যালবার্ট বাস সত্যিই স্বপ্নের মতো ছিল। চাইলেই কেউ অনায়াসে বাসের ছাদে বসে খানিক অন্যরকম সময় কাটাতে পারতেন। বাসের নিচের ডেকে ছিল একটি পড়ার ঘর এবং একটি খাওয়ার ঘর। এমনকি বিলাসবহুল এই বাসের উপরের ডেকে বসে সামনের দৃশ্য উপভোগ করার মনোরম সুযোগও ছিল। এছাড়াও ছিল সমস্ত সুযোগসুবিধা দিয়ে সাজানো একটি রান্নাঘর। শুধু তাই নয়, এই বাস-যাত্রা কালীন চাইলেই কেউ পেতে পারতেন অনুষ্ঠানের সুযোগ সুবিধাও। রেডিও, টেপ ইত্যাদি একাধিক সংগীতযন্ত্রের আয়োজন ছিল এই ‘অ্যালবার্ট’-এর মধ্যে। কিংবা যাত্রাপথে যাত্রীদের সুবিধার্থে এই বাসে হিটারের ব্যবস্থাও ছিল। এগুলি ছাড়াও বাসের ভিতরের সাজও ছিল নজর কাড়ার মতো। উজ্জল পর্দা, ঘুমের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, কার্পেট সব মিলিয়ে এলাহি আয়োজন। এইসব পরিপাটি আয়োজনে অ্যালবার্ট যেন যাত্রীদের কাছে এনে দিয়েছিল ঘর থেকে দূরে থেকেও ঘরে থাকার সুখের খোঁজ।

    ইংল্যান্ড থেকে কলকাতার পথে পাড়ি দিয়ে একে একে ইস্তাম্বুলের গোল্ডেন হর্ন, পুরানো দিল্লি, আগ্রার তাজমহল, গঙ্গার বেনারস, ক্যাস্পিয়ান সাগর উপকূল, ব্লু ড্যানিউব, ড্রাকোনিয়ান পাস, রাইন ভ্যালি, খাইবার পাস কিংবা কাবুল গিরিখাতের মতো অজস্র অসাধারণ জায়গাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসত অ্যালবার্ট। এছাড়াও বাড়তি পাওনা হিসেবে এই প্যাকেজে বরাদ্দ ছিল নতুন দিল্লি, কাবুল, ইস্তাম্বুল, তেহরান, ভিয়েনা, সালজবার্গ ইত্যাদি আরও অনেক জায়গায় বিনামূল্যে কেনাকাটা করার সুযোগও।

    কয়েক বছর চুটিয়ে যাতায়াত করার পর আকস্মিক এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বাসটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তার কিছু পরে অ্যান্ডি স্টুয়ার্ট নামে এক ব্রিটিশ পর্যটক এই বাসটিকে কিনে নেন। পরবর্তীকালে তিনি এটিকে একটি ‘ডবল-ডেকার মোবাইল হোম’ হিসাবে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন, যা আবার পরবর্তী যাত্রার সূচক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালের ৮ অক্টোবর আবারও সিডনি থেকে লন্ডন হয়ে ভারতের পথে নতুন করে যাত্রা শুরু করে ডবল ডেকার বাসটি। ‘সেন্ট্রাল ওয়েস্টার্ন ডেইলি’-র একটি প্রতিবেদন অনুসারে, স্টুয়ার্ট ১৩ জন সহযাত্রী নিয়ে সিডনির মার্টিন প্লেস থেকে শুরু করেছিলেন প্রায় ১৬০০০ কিলোমিটার পথের এই যাত্রা।  ১৩২ দিন পর, ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে আসেন তিনি। অ্যালবার্ট ট্যুরস ছিল ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার এমন একটি কোম্পানি যেটি লন্ডন-কলকাতা-লন্ডন এবং লন্ডন-কলকাতা-সিডনি রুটে যাতায়াত করত।

    বাসটি ইরান হয়ে ভারতে পৌঁছে তারপর বর্মা (বর্তমানে মায়ানমার), থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া হয়ে সিঙ্গাপুরের পথে পাড়ি দিত। আরও এক মজার কথা হল, সিঙ্গাপুর থেকে বাসটিকে নাকি জাহাজে করে অস্ট্রেলিয়ার পারথ্‌-এ যাওয়া হতো এবং সেখান থেকে আবার সড়কপথে সিডনির উদ্দেশ্যে চাকা গড়াত ডবল ডেকারের। লন্ডন থেকে কলকাতা নতুন করে শুরু হওয়া এই পরিষেবার জন্য নতুন ভাড়া নির্ধারিত হয় ১৪৫ পাউন্ড। নতুন হলেও আধুনিক সব সুযোগসুবিধা আগের মতোই বহাল ছিল এটাতেও।

    অবশেষে ১৯৭৬ সাল নাগাদ ইরানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ক্রমশ তুঙ্গে উঠল পাশাপাশি যোগ দিল ভারত–পাকিস্তান অশান্তি। ফলে কোপ পড়ে বাসটির ওপর। বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিষেবা। কলকাতা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রায় ১৫টি এবং ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে চারটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়েই এই ‘অ্যালবার্ট ট্যুর’-এর যাত্রাপথ পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত, এতদিনের যাত্রার এই সঞ্চয় বলতে ছিল প্রায় ১৫০টি দেশের সীমানা ছুঁয়ে আসার মতো অসাধারণ অভিজ্ঞতা আর ছিল নানা দেশ থেকে পাওয়া নতুন শিরোপা, ‘ফ্রেন্ডলি অ্যাম্বাসাডর’।

    মূল প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @