লিটল ম্যাগাজিন কিনুন ভাবুন পড়ুন : বলছে সার্ভে পার্ক দুর্গাপুজো

দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরের সার্ভে পার্ক এলাকা। ব্যস্ত রাস্তার পাশের গলিতে খানিক জায়গা নিয়ে চলে একটি তথাকথিত ছোটো পুজো, এই পুজোকে আজও সবাই পাড়ার পুজো নামে ডাকে। সেই পুজো এবার পা দিল ৪৬তম বর্ষে। এই প্রথম সার্ভে পার্ক পুজো কমিটি (Survey Park Durgotsav Committee)-র পুজোতে থিমের মণ্ডপ এবং থিমের প্রতিমা-র আগমনী। পাড়ার ছোটো পুজোর বড়ো চমক হিসাবে সেই থিমে উপস্থিত লিটল ম্যাগাজিন আর সন্দীপ দত্ত। থিমের নাম ‘স্মৃতির আড়ালে লিটল ম্যাগাজিন’। থিমে ধরা পড়ছে লিটল ম্যাগাজিন, সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরি আর বাঙালির বই পড়ার অভ্যেস।
লিটল ম্যাগাজিন। নামে লিটল হলেও বাংলা সাহিত্যের মহাবিশ্ব, যার মধ্যে দিয়ে সাহিত্যের জল গড়িয়ে যাচ্ছে বহু পুরাতন সময় থেকে আজও। অসংখ্য কিংবদন্তি লেখকের সাহিত্য-প্রতিভার হাতেখড়ির আঙিনা। লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের এমন এক মিলনক্ষেত্র, যেখানে খ্যাতনামা সাহিত্যিকের পাশে অনায়াস স্থান পান অনামী প্রতিভা। কিন্তু এই লিটল ম্যাগাজিন যে আজও বেঁচে রয়েছে, হারিয়ে যায়নি, তার জীবনদাতা একজনই। সন্দীপ দত্ত। ন্যাশনাল লাইব্রেরি-তে বাতিল ম্যাগাজিনের ঢাঁই দেখে লিটল ম্যাগাজিন বাঁচানোর তাগিদ। সেখান থেকে শুরু করে নিজের বাড়িতে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করা- তাঁর কাছে যত্নে রাখা আছে লিটল ম্যাগাজিনের গোটা বিবর্তনকাল আর সাহিত্যের মণিমাণিক্য। বর্তমানে তিনি প্রয়াত, কিন্তু সেই লাইব্রেরি সগৌরবে বিরাজমান। সেই বহমান সাহিত্যসম্ভার, আর সেই সাহিত্যস্রোতের ভগীরথের প্রতি সম্মান জানিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের গল্প তুলে ধরছে সার্ভে পার্কের এই পুজো।
থিমভাবনায় ঝর্ণা ভট্টাচার্য। রূপায়ণে শিল্পী সুজিত সেন এবং সন্দীপ সাহা। আবহে থাকছে সুজয় বিশ্বাসের পাঠ, যেখানে শোনানো হবে লিটল ম্যাগাজিন আর সন্দীপ দত্তের গল্প। সুজিত সেন বঙ্গদর্শন.কম-কে জানান, “শুধু লিটল ম্যাগাজিনই নয়, সামগ্রিক যে বই পড়া, পড়ার অভ্যেস, পড়ার গুরুত্ব, সবকিছুকে তুলে ধরাই আমাদের থিমের উদ্দেশ্য। তার প্রেক্ষাপট হিসাবে থাকছে লিটল ম্যাগাজিন, আর তার প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত।” আরেক শিল্পী সন্দীপ সাহা যোগ করেন, “এমন কোনও লিটল ম্যাগাজিন নেই, যা সন্দীপবাবুর সংগ্রহে নেই! সেগুলি প্রায় সবই পুরোনো কাগজের দোকানে বিক্রি হয়ে যেত, যদি তিনি যত্ন করে সংগ্রহ না করতেন। এভাবে বহু লেখাকে, লেখকের পরিশ্রমকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি। লেখাই যাঁদের একমাত্র সম্বল, তাঁদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিলেন সন্দীপ দত্ত। তাই এই থিমের জন্য তাঁর থেকে যোগ্যতর আর কে-ই বা আছেন?”
সেই জন্য মণ্ডপটি তৈরি হচ্ছে টেমার লেনের লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালার আদলে। মণ্ডপে ঢোকার মুখে দু-দিকে সাজানো থাকবে বই। কিছু আসল, কিছু প্রতিকৃতি। লিটল ম্যাগাজিনগুলি বেশ কিছু সংগ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সন্দীপ দত্তের সংগ্রহশালা থেকে কোনও ম্যাগাজিন সংগ্রহ করা হয়নি। গোটা মণ্ডপের ভিতরের দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের ছবি এঁকেছেন শিল্পীরা- পেখম, কৃত্তিবাস, মেঘবল্লভ, প্রভীকী...। মাঝের স্থানগুলিতে থাকবে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের প্রতিকৃতি। সুজিতের কথায়, “লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে সাহিত্যের আগল ভেঙেছে প্রতিবার। লিটল ম্যাগাজিন মানে সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সোচ্চার মঞ্চও। সেই দিকটা তুলে ধরতেই এই মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ভাবনা।” মণ্ডপের ভিতরে থাকবে সন্দীপ দত্তের একটি মূর্তি, টেবিল, শেলফ জোড়া বই।
প্রতিমাতেও অভিনব বইভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন শিল্পীরা। দুর্গাপ্রতিমার হাতে ত্রিশূলের বদলে থাকছে কলম। আর বাকি হাতে থাকছে বই। আর অসুরের সারা গায়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম- অধুনা এক্স, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের লোগো আঁকা রয়েছে। সুজিত জানান, “সামাজিক মাধ্যমের বেশ কিছু গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম একটা নেশার মতন ছড়িয়ে পড়ছে সব প্রজন্মের মধ্যেই। আর কেড়ে নিচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস। যা বই পড়া হয়, তারও বেশিরভাগ হয় ডিজিটাল মাধ্যমে। হাতে নিয়ে বই পড়া, নতুন বইয়ের গন্ধ, আর নতুন বই কেনার জন্য চাপা উত্তেজনা-আনন্দ, যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা তার বিরুদ্ধে বই পড়ার অভ্যাস ফেরানোর কথা বলছি। তাই আমাদের প্রতিমা কলম দিয়ে সামাজিক মাধ্যমের অসুরকে বধ করছেন, আর সবাইকে বই দান করছেন।” সুজিত আর সন্দীপ জানালেন যে, পুজোর উদ্বোধন করবেন সন্দীপ দত্তের স্ত্রী।
লিটল ম্যাগাজিন পড়ায়, লেখায়, ভাবায়। অনামী লেখকের ভাবনার চারণক্ষেত্র হয়ে ওঠে ম্যাগাজিনের পাতা, তাঁদের আশৈশব আর যুবক জীবনের টানাপোড়েন ছড়িয়ে যায় পাতাজুড়ে, দৃঢ় আর স্বচ্ছ শব্দচয়নে সাহিত্যরীতি বা বিষয়ভাবনার বাঁকবদল হতে থাকে। এক বৃদ্ধ বইমেলা চত্বর জুড়ে হেঁটে যান “লিটল ম্যাগাজিন কিনুন ও পড়ুন” স্লোগান তুলে। তাঁর ছোঁয়ায় শুধু ফ্যাশন বা রীতিতে নয়, প্রাণের আলো পায় সেইসব বাংলা লেখা, যাদের হয়তো মরে যাওয়ার কথা ছিল। আর সেই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে বই পড়া, বই বাঁচানোর ধুকপুক অভ্যাসের কথা বলে যায় ব্যস্ত রাস্তার পাশের পুজোমণ্ডপ- পুজোর পাঁচদিন উৎসব সেজে ওঠে জীবনবোধে।