No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বিশ্বভারতীতে নিজেদের অবস্থানে অনড় শতবর্ষীয় আলাপিনী মহিলা সমিতি

    বিশ্বভারতীতে নিজেদের অবস্থানে অনড় শতবর্ষীয় আলাপিনী মহিলা সমিতি

    Story image

    কেউ পঞ্চাশ, কেউ ষাট, কারো আবার আশি ছুঁই ছুঁই। তিনবছর কেটে গেছে, শান্তিনিকেতন আশ্রম প্রাঙ্গনে কয়েকজন প্রতিবাদিনী ইস্তেহারপত্র হাতে নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাঁদের আন্দোলন, ঠিকানা ফেরত পাওয়ার। যে ঠিকানা একদিন তাঁদের জন্য নিশ্চিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী, হেমলতা দেবী, প্রতিমা দেবী-রা।

    রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ হেমলতা দেবী এবং আশ্রমগুরুদের পত্নীরা ও অন্যান্য আশ্রমবাসিনীরা মিলে রবীন্দ্রনাথের কাছে আর্জি জানান যে, তাঁরা একটা সভা করতে চান যেখানে নিজেদের লেখা নিজেরা পড়া সঙ্গে গান বাজনা ইত্যাদিও হবে। এমন প্রস্তাবে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি হলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সূত্রেই একশো সাত বছর আগে, রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে ও প্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রথম মহিলা সমিতি—আলাপিনী মহিলা সমিতি। নামকরণ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিভিন্ন সময়ে যার সভানেত্রী—সহসভানেত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী, কিরণবালা সেন, বীণা বসু, পূর্ণিমা ঠাকুর, অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। আলাপিনীর সম্পাদিকার পদে ছিলেন, লীলা রায়, গান্ধিজির শিষ্যা বকুল গাঙ্গুলি, রেণুকা দাশগুপ্ত, রুবি গুপ্ত, মায়া মৈত্র প্রমুখ। 


     
    তখন শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতীর পরিবেশ ছিল আলাদা। আশ্রমিকদের চিন্তাভাবনা সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। আশ্রমের উন্মুক্ত পরিবেশে বিশ্বমানবিক বোধের আদর্শের জয়গান আন্দোলিত হতো বিশ্বভারতীতে। শান্তিনিকেতন আশ্রম থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্বভারতীর অস্তিত্ব যেমন স্বীকার করা যায় না, তেমনি এই আশ্রমেই লালিত আলাপিনী মহিলা সমিতির অস্তিত্বও প্রথম থেকে বিশ্বভারতীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। 

    আশ্রমের সমস্ত কাজেই এই সমিতির মহিলাদের কল্যানী হাতের স্পর্শ থাকতো। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে সমিতির সদস্যরা একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তারও নাম রেখেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ—‘শ্রেয়সী’। ক্ষিতিমোহন সেনের স্ত্রী  কিরণবালা সেন ছিলেন তার সম্পাদিকা। বিশ্বভারতীর ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারীবিভাগে ‘শ্রেয়সী’ প্রকাশিত হত। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, প্রিয়ম্বদা দেবী, সরোজকুমার দেবী, প্রমুখের লেখায় সমৃদ্ধ ছিল এই পত্রিকা। 

    আলাপিনীর সদস্যরা আশ্রমের ছাত্রছাত্রীদের নানান প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতেন। অসুস্থ ছাত্রছাত্রীদের সেবা, তাদের জন্য পথ্য তৈরি করা, প্রভৃতির মধ্য দিয়ে আশ্রমের কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতেন। রবীন্দ্রনাথ এঁদের ওপর অনেক ভরসা করতেন। তাছাড়া সদস্যরা বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন। অনেক সময়ই রবীন্দ্রনাথ নিজে সেখানে সভাপতিত্ব করেছেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমে তৈরি এই আলাপিনী’কে কেউ বিশ্বভারতী থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখতেন না। ১৯২২ সালে যখন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হয়, তার আগেই ১৯১৬-তে শান্তিনিকেতনে আলাপিনী মহিলা সমিতি তৈরি হয়ে গেছে। 

    বিভিন্ন সময়ে যার সভানেত্রী—সহসভানেত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী, কিরণবালা সেন, বীণা বসু, পূর্ণিমা ঠাকুর, অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। আলাপিনীর সম্পাদিকার পদে ছিলেন, লীলা রায়, গান্ধিজির শিষ্যা বকুল গাঙ্গুলি, রেণুকা দাশগুপ্ত, রুবি গুপ্ত, মায়া মৈত্র প্রমুখ।

    “প্রথম দিকে আলাপিনী’র অধিবেশন বসত কখনও উত্তরায়ণ-এ, কখনও বা ‘শান্তিনিকেতন’ বাড়িতে অথবা ‘দ্বারিক’-এ বা ‘দ্বিজবিরাম’-এ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর ভাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবী চৌধুরাণী ওরফে বিবিদির সভানেত্রীত্বের সময় সমিতির অধিবেশন বসত উত্তরায়ণে তাঁর ‘পুনশ্চ’ বাড়ির সম্মুখের বারান্দায়। পরে তাঁর সেবাপল্লীর বাসভবনে।” বলছিলেন সত্তোরোর্ধ্ব আলাপিনী’র বর্তমান সভাপতি অপর্ণা দাস মহাপাত্র। তিনিই সমিতির সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য। তিনপুরুষ ধরে তাঁরা আলাপিনীর সঙ্গে যুক্ত। তাঁর দিদিমা ননীবালা রায় শ্রীনিকেতনের সেবা বিভাগের শুরুতে প্রথম ভারতীয় মহিলা কর্মী। তাঁর মা আশ্রমকন্যা লতিকা রায় বিশ্বভারতীর প্রথম মহিলা স্নাতক, রবীন্দ্রনাথের ছাত্রী। শুধু তিনি নন, আলাপিনীর বেশির ভাগ সদস্যই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নানান ভাবে যুক্ত। কেউ বিশ্বভারতীর বর্তমান কর্মী, কেউ প্রাক্তন কর্মী, কেউ প্রাক্তন ছাত্রী কেউ বা বিশ্বভারতী কর্মীর ঘরনী। অনেকেই শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর সঙ্গে দু-তিন পুরুষ ধরে জড়িত। 

    তাই, বিশ্বভারতীর কর্মীপরিষদ এবং উপাচার্য যখন ঘোষণা করেন বিশ্বভারতীতে কোনও মহিলা সমিতি ছিল না, তখন আশ্চর্য তদুপরি মর্মাহত হন আলাপিনী’র সদস্যরা। আলাপিনী মহিলা সমিতির সঙ্গে অনেক চিঠিপত্রের আদানপ্রদান হয়  বিশ্বভারতীর অফিস ও অন্যান্য বিভাগের। 

    অপর্ণা দাস মহাপাত্র আরও বলছিলেন, “১৯৫৪ সালে ২০টি শিশু নিয়ে উত্তরায়ণে শ্যামলী’র প্রাঙ্গনে ‘আনন্দপাঠশালা’র উদ্বোধন হয়। পাঠশালাটি পরে একাধিকবার স্থানান্তরিত হয়, নাম বদলে হয় মৃণালিনী আনন্দপাঠশালা। আলাপিনীর সদস্যরা তখনও এই পাঠশালার ক্লাস নেওয়া, প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান দিতেন। এরপর ক্রমশ বিশ্বভারতী আনন্দপাঠশালা-কে তার নিজের কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। দেহলী-তে আনন্দপাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগেই ১৯৫৬ সালে ইন্দিরাদেবী যখন উপাচার্য হন, তখন দেহলী সংলগ্ন জীর্ণপ্রায় একটি ছোটো মাটির ঘরকে সারিয়ে আলাপিনীর অধিবেশন কক্ষ হিসেবে ঠিক করে দেন। পরে ৪০/৫০ জন সদস্যের বসার জায়গা সংকুলান না হওয়ায় জীর্ণ নতুনবাড়ির পশ্চিমদিকের বড়ো ঘরটি সারিয়ে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ আলাপিনীর দ্বিপাক্ষিক বৈকালিক অধিবেশনে ব্যবহার করার জন্য অনুমতি দেন। আমাদের ঘরের একটা চাবি থাকতো পাঠভবনের অধ্যক্ষের কাছে। আনন্দপাঠশালার সঙ্গে আমাদের হার্দিক যোগ যে কতটা, তা আলাদা করে আর বলছি না। কিন্তু, সেই আনন্দপাঠশালার যুক্তি দেখিয়েই নতুনবাড়ির একপ্রান্তে একটি ঘরে আলাপিনী’র দ্বিপাক্ষিক অধিবেশনে আপত্তি তুললো কর্তৃপক্ষ। আরও মর্মাহত হই, এই ব্যাপারে উপাচার্য আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনাতে বসতেও রাজি হননি। ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি রামকিঙ্কর মঞ্চে কর্মিপরিষদের সভায় প্রাক্তন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ঘোষণা করেন ‘বিশ্বভারতীর ইতিহাসে এই প্রথম একটি মহিলা সংগঠন তৈরি হলো—Women’s Assotiation of Visva Bharati. তাঁর এহেন মন্তব্যে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই।”

    আলাপিনীর সদস্যরা ছোটো ছোটো ছাত্রীদের আবাসে মাঝে মাঝে ঘরে বানানো খাবার নিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করে বাড়ির পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রআদর্শ অনুসরন করে সদস্যরা পার্শ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতন করাতেন, স্বাস্থ্যশিবিরের আয়োজন করতেন। ২০২০ সালে করোনাকালেও সাধ্যমতো এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। লকডাউনে গ্রামের দুঃস্থ মহিলাদের হাতে সাহায্যের হাত মিলিয়েছেন। উচ্ছেদ হওয়ার পরেও সক্রিয় থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে চলেছেন আলাপিনীর সদস্যরা। 

    বিশ্বভারতীর নানান অনুষ্ঠানে বিশেষত রবীন্দ্রসপ্তাহে ‘আলাপিনী সমিতি’র জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট থাকতো। আলাপিনীর মুখপত্র ‘শ্রেয়সী’ পত্রিকা প্রতিবছর ৭ পৌষ বিশ্বভারতীর উপাচার্য উন্মোচন করতেন। কিন্তু উপাচার্য পদে থাকাকালীন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী সেই রীতিতে সাড়া দেননি। একরাশ আক্ষেপ নিয়ে বলেন আলাপিনী’র সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য।   

    উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর আমলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালে ডিসেম্বর মাসে নোটিস জারি করে ২০২১ সালের প্রথম দিনেই সেই ঘর থেকে তাঁদের উৎঘাত করে দেন। এমনকি কর্মী পরিষদ প্রেস রিলিজ করে বর্তমান সম্পাদিকা জয়তী ঘোষ-এর নামে কুৎসা করে খুব অশোভন ভাষায় বিবৃতি দিয়েছিল। সমিতির তরফ থেকে উপাচার্যের কাছে সাক্ষাতে আলোচনার জন্য একাধিক বার চিঠি পাঠালেও তাঁর কাছ থেকে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। অবশেষে ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০-তে আলাপিনীর নতুনবাড়ির’র ঘরে শেষ অধিবেশন করে বিশ্বভারতীর ঘরছাড়ার নির্দেশের প্রতিবাদ করেন তাঁরা। কিছু মূল্যবান ফটো খুলে নিয়ে সমিতির সব জিনিসপত্র ঘরেই রেখে দেওয়া হয়। তারপর থেকে আনন্দপাঠশালার বাইরের গেটের সামনে ২ ঘণ্টা করে তাঁরা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের পরতিবাদে অবস্থানে বসছেন। আশ্রমের মধ্যে তাঁদের ঢূকতে দেওয়া হতো না। 

    বর্তমান অবস্থাটা তাহলে কী? এখন তো উপাচার্য বদল হয়েছে। যদিও তিনি অস্থায়ী... “হ্যাঁ, উনি আগে থেকেই সবটা জানতেন। কিন্তু তাঁর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা নেই বলেই তিনি আমাদের জানিয়েছেন। বিশ্বভারতী কমিটির নির্দেশের বাইরে বেরিয়ে তিনি কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তিনি বলেছেন, স্থায়ী উপাচার্য পদে যিনি আসবেন, তাঁকে পুরো বিষয়টা জানাবেন।” বলেন অপর্ণা দাস মহাপাত্র। 

    আলাপিনীর সদস্যরা তাঁদের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁদের লড়াই জারি রেখেছেন। অস্তিত্ব রক্ষায় জন্য প্রতিটি সদস্য একজোট হয়েছেন। যতদিন না বিশ্বভারতী তাঁদের স্বীকৃতি দিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনায় বসবে, তাঁরা আনন্দপাঠশালার সামনে বসে তাঁদের কর্মসূচী অব্যাহত রাখবেন। উৎঘাট হওয়ার পর থেকে যেমনটা তাঁরা করে এসেছেন। পথেই হয়ে চলেছে তাঁদের বিভিন্ন অধিবেশন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। টি এস এলিয়ট বলেছিলেন মানুষের জীবন নৈরাজ্যের বিকট ভাগাড়, চিরন্তন বিপ্লবই এর অভিপ্রায়। আর বিপ্লবে, আন্দোলনে মহিলারা বরাবর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। ৮ মার্চ দিনটি বোধহয় সেই কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যেই। 

    কৃতজ্ঞতা: 
    অপর্ণা দাস মহাপাত্র (আলাপনী’র সভাপতি)
    শর্মিলা রায় পোমো (আলাপনী’র সদস্যা)
    অরুন্ধতী সেনগুপ্ত (আলাপনী’র সদস্যা)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @