টেক্সাসের বাচ্চাদের ইস্কুলে বন্দুক হত্যালীলা — এ কি কোনো সভ্য দেশ নাকি?

আমেরিকা। হত্যালীলা। শিশুহত্যা। আরও একবার জাগিয়ে দিল অবক্ষয়ের যন্ত্রণা। আর মনের গভীরে ভীষণ ভয়। আমরা এই বর্বর ভয়ানক দেশেই থাকি। আমার মেয়েটা ওখানে থাকে, আর আমার ছোট্ট নাতনিটাও যে ওখানেই বড়ো হচ্ছে।
টেক্সাসের স্কুলের ঘটনা (Robb Elementary School Shooting) আরও একবার আমাকে নাড়িয়ে দিল। এত বছর আমেরিকায় বসবাসের সুবাদে বারবার এরকম পরিস্থিতিকে সামনে থেকে দেখেছি। আর ততবার আতঙ্কে ডুবে গিয়েছি। মনে হয়েছে এই ঘটনা তো আমার পরিবার, আমার মেয়ে, আমার নাতনির সঙ্গেও ঘটতে পারে। হতাশা গ্রাস করেছে। ভেবেছি এর থেকে বেরিয়ে আসার কী উপায়। অনেক খুঁজেও সে রাস্তা পাইনি।
আমেরিকায় সাধারণ মানুষের দরকার নিরাপত্তা। তাই আইন করে সবার হাতে তুলে দাও বন্দুক। নিরাপত্তা? কোথায় নিরাপত্তা?
রাগ হয়েছে? চালিয়ে দাও গুলি। কেউ তোমার জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করছে? সটান পকেট থেকে বেরিয়ে আসবে বন্দুক। সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। লাইসেন্স পরে। আগে খুন। গায়ের ঝাল মেটানো। তাতে যদি আমার জীবন শেষ হয়ে যায়, যাক না।
বন্দুক আমেরিকার মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট বা দ্বিতীয় সংশোধনী। প্রাগৈতিহাসিক এক নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে মানুষ যেন আগ্নয়াস্ত্রের দাস হয়ে গিয়েছে। বহু বহু বছর আগে যখন সাধারণের নিরাপত্তার জন্য এই আইন চালু হয়েছিল, তখন পরিস্থিতিটা একদম অন্যরকম ছিল। তখন নিরাপত্তার দরকার ছিল। দেশটা তখন নতুন। সবে নেটিভ উপজাতিগুলোকে কচুকাটা করে দিয়ে প্লেগ ছড়িয়ে দিয়ে এত বড়ো দেশটাকে দখল করেছে সাদা সাহেবরা। তারা মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করছে। তারপর উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে দাসপ্রথা নিয়ে যুদ্ধ। রাষ্ট্রবিপ্লব।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে পরিস্থিতি। মানুষকে এখন নিরাপত্তা দেয় পুলিশ, প্রশাসন। এই পরিস্থিতি নিরাপত্তা আইনের আওতায় থাকায় এই বন্দুক ব্যবহারের আইন তুলে দেওয়ার সময় এসেছে। পৃথিবীর কোথাও এমন বর্বর আইন নেই। এমন ভয়াবহ ঘটনাও নেই। কিন্তু আমেরিকার মিডিয়া কখনও অন্য দেশের কথা বলে না। কেউ জানেই না বাকি পৃথিবীটা কেমন করে ঘুরছে।
যতবার এমন ঘটনা শুনি ঠিক এটাই মনে হয়। আর ঠিক তার পরেই বুঝতে পারি এই আইন বদলের নয়। এই আইন বদলাতে হলে রাস্তায় নামতে হবে যুব সমাজকে। অতীতে একবার একটা অংশে এই আন্দোলন সাময়িক সময়ের জন্য মাথাচাড়া দিয়েছিল। কিন্তু তারপর সব যে কে সেই।
বাইরের জগতের কাছে আমেরিকার যে রূপ দেখা যায় আসলে আমেরিকা তা নয়। অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি আমেরিকার মানুষের অবক্ষয়ের কারণ। এখানের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ কলেজ যায়নি।
রাজনৈতিক দলগুলো কোনো মৌলিক পরিবর্তন চায় না।
আমেরিকার ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন বা এনআরএ একেবারেই চায় না। তারা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের বিরোধিতা কেউ করে না। সেনেটর কংগ্রেসম্যান বেশিরভাগ সব তাদের কেনা।
রাস্তায় ঘাটে বন্দুকবাজি। হাজার হাজার অস্ত্র বিক্রির দোকান। মিনিমাম বা জিরো ব্যাকগ্রাউন্ড চেক। আমার মেয়ে যখন ছোটো ছিল, তখন তার বেবিসিটারের বাড়িতে সাজানো বন্দুক দেখে আমার স্ত্রী আঁতকে উঠেছিল।
কত মায়ের কোল শূন্য হয়ে যাচ্ছে, শুধুমাত্র কারও সাময়িক ক্রোধের কারণে। টেক্সাসের উভালড — রব এলিমেন্টারি স্কুলের ঘটনা শুনে খুব একটা চমকে যাইনি। কিন্তু আতঙ্কটা আরও একবার গ্রাস করেছে। শুনলাম খুনির বয়স আঠেরো। সে নাকি এই স্কুলে হামলা চালানোর আগে বাড়িতে তার ঠাকুমাকে মেরেছে। সে এখন সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। তারপর ওই স্কুলে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। কে আটকাবে? হয়তো ওর ঠাকুমা ওকে আটকাতেই চেয়েছিল, জানি না ঠিক কী হয়েছিল। কিন্তু যাঁদের গেল তাঁদের তো সারাজীবনের জন্য চলে গেল।
আজ স্কুল, কাল কলেজ, পরশু শপিংমল, তার পরের দিন সিনেমা হল, কখনও ওপেন রাস্তায় অচেনা, অজানা সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে এই প্রজন্ম। এটা আরও বেশি আতঙ্কের। আসলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা তো তাঁদেরই ছিল। হয়তো এই ছেলেটির জীবনে এমন কোনও ঘটনা রয়েছে। প্রত্যেকেরই থাকে। কেউ তাঁকে অপমান করেছে, কেউ তাঁকে সমস্যায় ফেলেছে, কোথাও সে র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে— সব বদলা নিয়ে নাও, চালাও গুলি। পুলিশের গুলিতে সেও মারা গিয়েছে। কারও কাছে বাবার বন্দুক, তো কারও নিজের।
২০১২-তে কানেকটিকাটে কুড়িজন শিশু ও ছ’জন স্টাফের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এখনও তাজা রয়েছে — তার মধ্যেই আরও একবার।
একটা ঘটনা মনে পড়ছে। অনেক বছর আগে আমরা আলবেনিতে থাকতাম। একটা ছোট্ট জায়গা। সারাক্ষণ বরফে ঢাকা থাকত। তখন আমার মেয়ে ছোটো। আমাদের পাশের পাড়া থেকে একটি মেয়েকে বন্দুক দেখিয়ে অপহরণ করে নিয়ে চলে গেল। জানতে পেরে আঁতকে উঠেছিলাম। হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম — এ তো আমার মেয়ের সঙ্গেও হতে পারে। প্রতিদিন এই আতঙ্কেই বাঁচতে হয়।
আমাদের এই দেশে ভয়ংকর ভায়োলেন্স এখন সর্বত্র। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দলিতদের ওপরে ও নারীদের ওপরে নির্যাতন এখন সর্বত্র। এসব বিষয়ে ভারত আজ সারা পৃথিবীর তালিকায় সবচেয়ে নীচের দিকে। ভাবলে লজ্জা লাগে। আমেরিকার বন্ধুদের কাছে লুকিয়ে রাখি।
বাইরের জগতের কাছে আমেরিকার যে রূপ দেখা যায় আসলে আমেরিকা তা নয়। অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি আমেরিকার মানুষের অবক্ষয়ের কারণ। এখানের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ কলেজ যায়নি। এটাকে অশিক্ষা বলব না তো কী বলব।
ধর্মান্ধতা। বিজ্ঞানবিরোধিতা। বর্ণবিদ্বেষ। ইমিগ্রেন্টদের মনুষ্যেতর জীব বলে মনে করা।
বিকল্পের অভাব। রাগ, ক্ষোভ মানেই মানুষকে মেরে দাও। ভাবনা-চিন্তার জগতটা ক্ষুদ্র। আমেরিকার মতো বর্বর আইন কোনও দেশে নেই। এ এক আজব দেশ। চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে চরম মানসিক অবক্ষয়ের কাহিনি।
ড্রাগ, বন্দুক, পর্নোগ্রাফি। আমেরিকার তিন বিশালতম বাণিজ্য।
শ্রেষ্ঠ দেশ? হাসাবেন না আর।
হ্যাঁ, আমাদের এই দেশে ভয়ংকর ভায়োলেন্স এখন সর্বত্র। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দলিতদের ওপরে ও নারীদের ওপরে নির্যাতন এখন সর্বত্র। এসব বিষয়ে ভারত আজ সারা পৃথিবীর তালিকায় সবচেয়ে নীচের দিকে। ভাবলে লজ্জা লাগে। আমেরিকার বন্ধুদের কাছে লুকিয়ে রাখি। ওরাও সৌজন্যের খাতিরে ঘাঁটায় না।
কিন্তু অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে এসে বাচ্চাদের ইস্কুলে শিশুহত্যা? প্রতিদিন দেশটার কোণে কোণে নির্বিচারে হত্যালীলা — বন্দুকবাজির বলি অসংখ্য সাধারণ মানুষ?
ঈশ্বর, আমাদের তো নিয়ে গেছো ওই অভিশপ্ত দেশে। আমার মাতৃভূমিকে এই বীভৎসতার হাত থেকে বাঁচাও।
*মতামত লেখকের নিজস্ব