জিভে জল-আনা বসিরহাটের পাটালি

বসিরহাটের পাটালি আর নলেন গুড়ের সন্দেশ - নাম শুনলেই বাঙালির জিভে জল আসে। বসিরহাটের পাটালি জগৎ বিখ্যাত। সুস্বাদু আর আসল পাটালির ব্যবসা করে বহু নিম্নবিত্ত পরিবার বেঁচে থাকে। প্রশ্ন হল, আসল পাটালি চিনবেন কী করে? আম বাঙালির বরাবরই দেখতে সুন্দর, সাদা পাটালির প্রতি ঝোঁক। কিনে নিয়ে আসার পর বলেন, নাহ! এবছর সেই আগের মতো গন্ধ আর স্বাদ পেলাম না। এই আধুনিক যুগে চারিদিকে এত মোবাইলের টাওয়ার, সব গাছের রস শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই আসল গুড় আর মিলছে না। আপনি হয়তো জানেন, ওই পাটালিতে গুড়ের বদলে চিনি বেশি। এক কিলো পাটালিতে ছ’শো গ্রাম চিনি আছে। আর আছে ফিটকিরি। ফিটকিরি দেওয়ার কারণেই রঙ সাদা হয়েছে। ফিটকিরির ভাগ যদি কখনও বেশি পড়ে, তাহলে হালকা তিতো লাগবে স্বাদে। আপনাকে ব্যবসায়ী বলবেন, এখন গাছের রসও তিতো হয়ে যাচ্ছে। পাটালি বা গুড় ঘরে রাখলে গন্ধ পাবেন না। আপনি মনে মনে ভাবছেন, আগে তো বেশ গন্ধ পাওয়া যেত! প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন হচ্ছে? খেজুর গাছ থেকে যাঁরা রস বের করেন তাঁদের বলা হয় শিউলি। একটা গাছ থেকে এক সপ্তাহে পরপর তিনদিন রস পাওয়া যায়। প্রথমদিনের রসকে বলা হয় জিরান রস। আগের দিন বিকেলে গাছ কাটার পর নল দিয়ে যে রস বের হয় তা পেড়ে নিয়ে আসা হয় ভোরে। সূর্যের আলো ফোটার আগে সেই রস বাড়ি আসে, সেই জিরান রসে যে গুড় হয় তার গন্ধে ম-ম করে পাড়া। এই রস জ্বালিয়ে গুড় বের করা হয় সকাল সাতটার মধ্যেই। একে বলা হয় জিরান গুড়। এ-গুড়ের আবার জ্বালানোর নিয়ম আছে। রস জ্বালাতে জ্বালাতে যখন সরষে ফুলের মতো ফুটবে তখন নামিয়ে নিয়ে ভালো করে চাকি দিয়ে ঘষে ঘষে গুড় তৈরি হয় আর তা হল সুস্বাদু পাটালি। এই পাটালির গন্ধে এখনও পাড়া ম ম করে। শক্ত হয় না, আঙুলের হালকা টোকায় ভেঙে যায় পাটালি। আর স্বাদ? মন ভোলানো। এখনও মৌমাছি উড়ে আসে।
এ তো বললাম প্রথম দিনের রসের গল্প। দ্বিতীয় দিনের রসে যে গুড় হয় তার তত স্বাদ নেই। তৃতীয় দিনের রসকে বলা হয় ওলা রস। গ্রামে এই রসের গুড়ে ক্ষীর তৈরি হয় অথবা গর্ভবতী গরুকে খাওয়ানো হয়। সদ্য মা হওয়া গরুকে খাওয়ালে বেশি দুধ দেয়। সেই রসের ফিটকিরি আর চিনি মিশিয়ে গুড় তৈরি হয় আর সেই গুড় খাই আমরা।
প্রশ্ন হচ্ছে, জিরান রসের গুড় তাহলে যায় কোথায়? ব্যবসায়ীরা মুখিয়ে আছেন।যখনই শিউলি গুড় তৈরি করবেন তার আগে অগ্রিম দেওয়া হয়। জিরান রসের গুড় কিনে নিয়ে পাঠিয়ে দেন ভিনরাজ্যে বা বিদেশে। জিরান রসের গুড়ের পাটালির দাম এবছর এক কিলো বিক্রি হয়েছে আড়াই শো টাকা আর আপনি যে পাটালি কিনেছেন তা বিক্রি হয়েছে দেড়শো টাকায়।
আরও পড়ুন
মিষ্টির মেদিনীপুর
নলেন গুড়ের সন্দেশ বলে আমরা যা খাই তা আসলে নলেন গুড়ের কি? নলেন গুড় কাকে বলে? গাছ কাটলে বছরের প্রথমে যে গুড় পাওয়া যায় তাকে বলে নলেন গুড়। সে গুড়ের মিষ্টি আকাশকুসুম। বেশি দাম দিয়েও মিলবে না। আপনি যা খাচ্ছেন হয় বাজারের গুড়, যাকে আমরা ভেলি গুড় বলি নতুবা রঙ আর সুগন্ধী।
বসিরহাটে গেলে এখনও জিরান রসের গুড় বা পাটালি বহু বাড়িতে পাবেন। দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ইছামতীর ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে যাবেন। দু’পাড়ে বহু গ্রামে খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন। ঠকবেন না কখনও। তবে আসল বলে ফিটকিরি দেওয়া নকল পাটালি এড়িয়ে যাওয়া ভালো, বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসবে ক্যানসার, পেটের অসুখ হতে পারে। এখন তো আবার তাল পাটালির সময়। সাদা পাটালি কিনবেন না।