পায়ে হেঁটে জানুন কলকাতার ইতিহাস

কোভিড মহামারি এসে প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক প্রাণ। সাধারণ জীবনের সংজ্ঞাই পালটে গিয়েছে। তবে আমরা জানি, এই দুর্যোগ কেটে যাবে একদিন। কোনো সংকটই চিরকাল থাকে না। মহামারির পর এমন কিছু আমাদের করতে হবে, যা আগে কখনই করিনি। তিলোত্তমা কলকাতাকে নতুন করে চেনা যেতে পারে রাস্তায় নেমে। উদ্দেশ্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা বলছি না। প্রত্যেক সপ্তাহে আপনাকে মহানগর ভ্রমণের একটি করে নীল নকশা দেবো আমরা। কোনখান থেকে শুরু করবেন, কোথায় গিয়ে শেষ করবেন, তার পথনির্দেশ দেবো। লকডাউনে যদি হাঁটার সুযোগ পান, পরের সপ্তাহ থেকেই বেড়িয়ে পড়ুন শহরের আনাচে কানাচে।
প্রথম দিনের সফর বিবাদী বাগ এলাকায়। অভিজাত ইংরেজ সাহেবদের বাস ছিল এখানে। অল্প কয়েকটা জায়গা ঘুরে দেখুন। পরের বার থেকে আস্তে আস্তে গন্তব্যের সংখ্যা বাড়বে। চলুন শুরু করা যাক –
রাজভবন
উনিশ শতকের শুরুতেই কলকাতা হয়ে উঠেছিল ‘প্রাসাদের শহর’। ‘প্রাচ্যের সেন্ট পিটার্সবার্গ’-ও বলা হত। ঔপনিবেশিক ভারতের সবথেকে বড়ো, ধনী এবং জমজমাট শহর। রাজভবনের মতো বিশাল অট্টালিকা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যেত। ১৭৯৯ সালে গভর্নমেন্ট হাউজ হিসেবে গড়ে ওঠে এই বাড়ি। সেবছর ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি একটি প্রাসাদ তৈরির উদ্যোগ নেন ‘শাসক শ্রেণি’-র জন্য। আগের গভর্নর-জেনারেলরা দেশ শাসন করতেন ভাড়া করা ম্যানসন থেকে। এখনকার রাজভবনের জায়গাতেই ছিল সেই বাড়ি।
গভর্নমেন্ট হাউজ গড়ে উঠতে সময় লাগে ৪ বছর। নির্মাণের জন্য অনেক বেশি খরচ হয়। ৬৩,২৯১ পাউন্ড বা এখনকার হিসেবে ৩৯ কোটি টাকা। ১৮০৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগে ইংল্যান্ডে ডেকে পাঠানো হয় লর্ড ওয়েলেসলিকে। চাকরিটা গেল বটে, কিন্তু কলকাতার অন্যতম সেরা ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের স্রষ্টা হয়ে থাকলেন ইতিহাসের চোখে। ১৮৯২ সালে ভারতের প্রথম এলিভেটর লাগানো হয় রাজ ভবনে। দায়িত্বে ছিল স্বনামধন্য ওটিস এলিভেটর কোম্পানি।
ট্রেজারি বিল্ডিং
রাজ ভবনের উত্তর দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যদি পশ্চিমে যান, গিয়ে পড়বেন কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিটে। এই রাস্তা যেখানে কিরণশঙ্কর রোডে পড়েছে, সেখানে আগে ছিল কাউন্সিল হাউজ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা এটি তৈরি করেছিলেন ১৭৬৬ সালে। ওয়েলেসলির আমলে ১৭৯৭ সালে কাউন্সিল হাউজ এবং আরও কয়েকটি ব্যক্তিগত বাড়ি ভেঙে ট্রেজারি বিল্ডিং বানানোর কাজ শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতের অর্থ দপ্তরের আধিকারিকরা বসতেন এখানে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অ্যাকাউন্টস এবং অডিট বিভাগের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিস রয়েছে আজ।
ট্রেজারি বিল্ডিং
সেন্ট জন’স চার্চ
ব্রিটিশ ইস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বসাধারণের জন্য প্রথম যে ক’টি স্থাপত্য বানায়, তার মধ্যে অন্যতম সেন্ট জন’স চার্চ। এখন রয়েছে রাজ ভবনের উত্তর-পশ্চিম কোণে। ১৮৪৭ সালে সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল গড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত এটি ছিল কলকাতার অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রাল। ১৭৮৪ সালে এই গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। খরচ তুলতে পাবলিক লটারির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। জমি উপহার দেন শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর। ১৭৮৭ সালে গির্জা তৈরির কাজ শেষ হয়।
সেন্ট জন’স চার্চ
আর্মেনিয়ান চার্চ অফ হোলি নাজারেথ এবং ওল্ড মিশন চার্চের পর কলকাতার তৃতীয় প্রাচীন গির্জা এই সেন্ট জন’স চার্চ। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই শেষ নয়। গির্জার কবরখানায় শায়িত আছেন জোব চার্নক, লেডি ক্যানিং, বেগম ফ্রান্সিস জনসনের মতো বিশিষ্টজনেরা। কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ডের স্মরণে গড়ে তোলা হয়েছে ব্ল্যাকহোল মনুমেন্ট। এই গির্জাতেই রয়েছে প্রখ্যাত শিল্পী জোহান জোফানির আঁকা ‘লাস্ট সাপার’। যেটিকে কয়েক বছর আগে সংস্কার করে পুরোনো গৌরবে ফিরিয়ে আনা হয়।
কমার্শিয়াল লাইব্রেরি
সেন্ট জন’স চার্চ থেকে কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিটের বাঁদিকে ঘুরুন। খানিকটা হাঁটলেই দেখতে পাবেন জমকালো লাল রঙের স্থাপত্য। ১৮৮৫ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস ভারতে এলে তাঁর সম্মানে এটি নির্মিত হয়। পরে তিনি রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড নামে সিংহাসনে বসেন। বিশাল বাড়িটির রাজকীয়তা আজও স্পষ্ট। দোতলায় রয়েছে কমার্সিয়াল লাইব্রেরি। ভারতের আমদানি, রপ্তানি এবং শিল্প উদ্যোগের নানান তথ্যের খনি লুকিয়ে আছে লাইব্রেরির বই এবং নথিগুলোয়।
কমার্শিয়াল লাইব্রেরি
জিপিও এবং ডাক জাদুঘর
নেতাজি সুভাষ রোড এবং কয়লাঘাট স্ট্রিটের মাঝখানে জেনারেল পোস্ট অফিস। ফোর্ট উইলিয়াম আগে এখানেই ছিল। পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা চলে গিয়েছে, বলা হয়, সেখানেই এক কয়েদখানায় নাকি ১৭৫৬ সালে কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। কলকাতার সবচেয়ে সুন্দর ঔপনিবেশিক বাড়িগুলোর একটি নিঃসন্দেহে জিপিও। কিংবদন্তি স্থপতি ওয়াল্টার বি গ্রেনভিল এটির নকশা তৈরি করেন ১৮৬৪ সালে। ১৮৬৩ থেকে ৬৮ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারত সরকারের উপদেষ্টা স্থপতি। পূর্ব দিকের সিঁড়ির গায়ে দেখতে পাবেন পিতলের একটি পাত, যাতে নির্দেশ করা আছে পুরোনো ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্ব সীমানা।
জিপিও এবং ডাক জাদুঘর
জিপিও-র সঙ্গে ফিলাটেলিক ব্যুরো এবং ডাক জাদুঘর দেখতে ভুলবেন না। জাদুঘর রয়েছে জিপিও-র দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি লাল বাড়ির একতলায়। ভারতের ডাক পরিষেবার ইতিহাস চোখের সামনে ফুটে উঠবে সেখানে।
কলকাতার রাস্তায় যতই ঘুরে বেড়াবেন, একের পর এক সামনে আসবে ঔপনিবশিক যুগের ঐতিহ্য। আজ এইটুকুই থাক। বাকিটা পরের সপ্তাহে হবে। সফর শুভ হোক।