তথাস্তু

১
সকাল থেকে খ্যাচখ্যাচ আর ভাল্লাগে না মাইরি! এই হয়েছে শালা দত্তবাড়ি। কোনকালে ঘি খেয়েছে, এখনও আঙুল শোঁকে। অথচ নামেই তালপুকুর। ঘটি ডোবে না।
মা সেই কেত্তন শুরু করে সকালে এক কাপ চা দেওয়া ইস্তক। চাকরি হল না, চাকরি হল না ।
আরে, চাকরি কি ছেলের হাতের মোয়া?
চাইলেই টুপ করে গাছপাকা আমটির মতো খসে পড়বে? বাবা তো ভালোমুখে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছে।
দিদির খালি কাঁদুনি আর রমেনদার "ব্রাদার ব্রাদার "বলে ডেকে বারফট্টাই। শালা সাধারণ গ্র্যাজুয়েট আমি।
এ বাজারে খুঁটির জোর আর চাঁদির জোর না থাকলে চাকরি হয়?
আমি। দেবেশ দত্ত। তালপুকুরের দত্তবাড়ির শিবরাত্রির সলতে। কিন্তু এ সলতে মিইয়ে যাওয়া। তেল ফেল নেই। ;জ্বলে না। শালা, কেউ বুঝবে যে আমারও গলা দিয়ে ভাত নামে না? প্রেম ট্রেম পালিয়ে গেছে জানলা দিয়ে। চাঁদ গলি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রুপোলি আঁচল দুলিয়ে চলে যায়।
আরে, বিজন না? কী দিয়েছ গুরু! আঁতেল দাড়ি, উদাস চোখ, উড়ুক্কু চুল, ফ্যাব ইন্ডিয়ার পাঞ্জাবি আর আলিগড়ি, কাঁধে ডিজাইনার ঝোলা, পায়ে কোলাপুরি ...চললে কোথায়?
-- ও: দেবেশ? আরে কেমন আছিস তুই? কী করছিস এখন?
দেবেশের মুখটা চিরতার জল খাওয়ার পর যেমন।
--কী আর করব! দু-বেলা ভাতের থালার পাশে একটু করে ছাই খাচ্ছি। আর সন্ধেবেলা রকে বসে মামণিদের দেখে বুকে ব্যথা করছি। তুই কী করছিস এখন? দেখে তো মাইরি হেবি ভক্তি জাগছে।
-- আমি এখন ক্রিটিক। মানে সমালোচক। এই সিনেমা, নাটক, ছবি, গান , বইপত্তর ... এ সবের।
-- এতে চলে তোর?
-- ঠিকঠাক লেগে থাকতে পারলে আর মার্কেট ধরতে পারলে মন্দ নয়। আর সঙ্গে খাতির ফ্রি।
-- আমাকে দাও না গুরু ..কিছু লাইন। ইস্কুলে তো আমরা কেউই কখনো ফার্স্ট বেঞ্চে বসিনি !
-- নিজেকে তৈরী করতে হবে। পারবি?
--পারতেই হবে বস। বাড়িতে ওল্ড ম্যানের দাঁত খিঁচুনি আর পোষাচ্ছে না।
-- তাহলে ঠিকানা দিচ্ছি। স্ট্রেট চলে যা। বিধাতাদাকে আমার রেফারেন্স দিবি।
-- কাকে?
-- বিধাতা মহাজন। একটা ওয়ার্কশপ চালান। এক মাসের ক্র্যাশ কোর্স। নানা ধরনের প্রফেশনের। তারপর একটা পরীক্ষা। হাজার পনেরো লাগবে কিন্তু ।
-- ম্যানেজ করে নেব বস। মা দেবে। চুপিচুপি চেয়ে নেব। ওই বুড়ির জন্যই এখনও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে।
বিধাতা মহাজন আজকাল বড়ই ম্রিয়মাণ থাকেন।
আগে আগে নিশুতি রাতে গিয়ে তাঁর নেমসেক সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুটির কপালে ইচ্ছে সুখে যা লেখালেখি করে আসতেন, তাই ঠিকঠাক ফলে যেত।
আজকাল লিখে আসেন ঠিকই, কিন্তু বাপ মায়েরা বেদম সেয়ানা হয়ে গেছে।
এখন চারদিকে ছেলেপুলে মানুষকরার হরেকরকম কারখানা তৈরী হচ্ছে।
সেখানে গাধা পিটিয়ে ঘোড়া, ঘোড়া পিটিয়ে মানুষ ..সব করা সম্ভব।
সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে চাঁদির চাঙ্গায়নী সুধা সেবন করিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধি সম্ভব।
দলে দলে ছেলেপুলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে শেফ, শিল্পী, গায়ক, লেখক হয়ে যাচ্ছেঅবলীলায়। ফলে সব জায়গাতেই ভীষণ ভীড়।
সবাই এক্সপার্ট। সবার গায়েই ছাপ্পা মারা। এখন সকলেই যদি বলে, "আমায় দেখ”, তাহলে তাঁর নেমসেকের কারিকুরি দেখেই বা কে আর তাঁকে পোঁছেই বা কে!
বিধাতা মহাজন বিমর্ষ হয়ে বসেছিলেন ফাঁকা অফিসঘরে।
স্রেফ একটি পায়াভাঙা নড়বড়ে টেবিল আর চটা ওঠা পেরেক বার করা চেয়ার সম্বল করে।
এভাবে চললে ব্যাবসা লাটে উঠল বলে ! এমন সময়ে একটি যুবক সেখানে এসে দাঁড়াল। তার সব কিছুই মাঝারি।
একনজর তাকালেই বোঝা যায়,পোশাকের দাম মাঝারি, জুতোর মান মাঝারি, চেহারা মাঝারি, চশমার পাওয়ার মাঝারি, বুদ্ধিশুদ্ধিও মাঝারি।
বিধাতা কিঞ্চিৎ উষ্মা সহকারেই জিজ্ঞেস করলেন,br /> ---এ দিকে কী মনে করে?
-- আজ্ঞে, চাকরিবাকরি নেই।
-নাম কী?
- দেবেশ দত্ত ।
বিধাতা মুখ ব্যাজার করলেন।
মনে মনে বললেন,
“ঠিক যা ভেবেছি! নামটা আর পদবীটা পর্যন্ত মাঝারি! অথচ আজকাল দেখো, বাপ মা এমন নাম দিচ্ছে ছেলেপুলেদের, যে শুনলেই সম্ভ্রম জাগে! অয়স্কান্ত, নভোনীল, সৌরদীপ্ত ...। পদবীতে গ্রাম্ভারী ভাবটা থাকলেও তো হত! ঠাকুর না হোক নিদেন পক্ষে চাটুজ্যে, বাঁড়ুজ্যে।
তা নয়,দেবেশ দত্ত! কোনো মানে হয় !”
- তা আমি তো বাপু চাকরি দেবার ফ্র্যানচাইজি নিইনি।
আজ্ঞে, একটু দেখুন না ..মানে কুঁজোরও তো চিত হয়ে শুতে সাধ যায়! আমার বড় ইচ্ছে লোকে আমাকে সমীহ করুক।
ছোকরা বিধাতার পায়ে সটান ডাইভ দিল।
-- আমাকে বাঁচান স্যার। কারো কাছে কলকে পাই না।
- কী পারো তুমি? মানে কিছুমিছু তো পারো? ওই লাইনেই ভেবে দেখি তাহলে।
-- ঠিকঠাক কিছুই পারি না স্যার। মাইরি বলছি।
তবে রকে রাজা উজীর মেরে অভ্যেস আছে।
আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না স্যার।
আমাকে পাঠিয়েছে আমার ইস্কুলের বন্ধু বিজন। সব শুনেই এসেছি স্যার। আপনার দক্ষিণাও এনেছি।
-- ইস্কুল কলেজ?
-- ঝাঁ চকচকে কিছু রেজাল্ট নয় স্যার, তবে চলনসই। ;একেবারে হ্যাক থু নয়।
একটা উপায় বাতলে দিতে পারি। তবে একটু খাটনি আছে। তুমি কি পারবে?
-- পারতেই হবে স্যার। আয়নার সামনে দাঁড়াতে লজ্জা করে। জীবনে একটা কিছু করে দেখাতেই হবে স্যার।
-- তুমিও বিজনের মতো সমালোচক হয়ে যাও। ওইটেই তোমার লাইন। একবার যদি ধরে ফেলতে পারো কায়দাটা, দেখবে তোমাকে লোকে মাথায় তুলে রাখবে । তবে পরিশ্রম করতে হবে।
-- আপনি একটু গাইড করে দিলেই পেরে যাব স্যার। আমায় ভর্তি করে নিন স্যার। অনেক আশা করে এসেছি ।
-- বেশ।
প্রথমে যেটা মনে রাখতে হবে, তা হল... তোমার যা বিদ্যেবুদ্ধি, তাতে জ্ঞানী সমালোচক হতে গেলে হালে পানি পাবে না। ছড়িয়ে লাট করে দেবে। তোমাকে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' এই আপ্তবাক্যটি সার করতে হবে। কোনো কিছুর গভীরে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই তোমার। ওই পাঁকাল মাছেরমতো সেয়ানা হবে। ভাসা ভাসা মতামত দিয়েই ছেড়ে দেবে। আর ওপর ওপর কিছু কিছু দেশী বিদেশী বিখ্যাত নাম ধাম কাজকম্ম মগজে ঠুসে রাখবে। দরকারমতো ঝেড়ে দেবে। বিদেশী হলেই ভালো। কারণ তোমাদের ওই ছাতার সমাজে তো আবার স্বদেশী ঠাকুরের, ঠাকুর মানে রবিবাবু নয়,স্বদেশী ঠাকুরের চেয়ে বিদেশী নামের দাম বেশি।
-- তা আমার কাজটা কী হবে?
-- সমালোচনা করতে হবে। ট্যাক্টফুল ক্রিটিসিজম একটা আর্ট। সবাই পারে না। তুমি কী চাও? সবাই তোমাকে মানবে গুনবে। তাই তো? তার জন্য এই বয়সে তো আর নতুন করে মগজে মেধার চাষ করতে পারবে না! তোমাকে সে জন্য বোদ্ধা হতে হবে। ঠিক বোদ্ধা নয়, সে বুদ্ধি তোমার নেই। বোদ্ধাহওয়ার ভান করতে হবে। যেমন ধর, তুমি যখন সিনেমার সমালোচনা করবে, ত্রুফো, গদার, ফেলিনি, কুরোসাওয়া এমন সব নামধাম, এদের বিখ্যাত সিনেমা, কাজের ধরন মাথার গেঁথে রাখবে। স্প্যানিশ, ইরানী ...যেখানে যত বিখ্যাত পরিচালক, ছবি..একটা খাতা মেনটেন করবে । রেডিরেফারেন্সের জন্য । আমার অত তো মনেও থাকে না ছাই ! আরে, ওই নেট, গুগুল ...ওই সব সবজান্তা দাদামশাইদের কাছে সব তথ্য পেয়ে যাবে। সেই সঙ্গে ভারতীয় কিছু নামটামও লিখে রেখো। বেনেগাল, সত্যজিৎ, আদুর, মণিরত্নম । যা সিনেমার সমালোচনা করবে, দু-চার লাইন করে লিখেই একটাকরে দেশী -বিদেশী রেফারেন্স গুঁজে দেবে। যাতে লোকে ভাবে, তোমার ব্যাপক বিদ্যের বহর। কাউকে আর খাপ খুলতে হবে না!
ঠিক একইভাবে ছবির সমালোচনা। একদম অজন্তা -ইলোরার গুহাচিত্র থেকে কালিঘাটের পটচিত্র। অবন ঠাকুর থেকে মকবুল ফিদা। ওদিকে যত "ইজম" আছে ... ইম্প্রেশনিজম থেকে পয়েন্টিলিজম, সাররিয়ালিজম থেকে কিউবিজম কিচ্ছুটি বাদ দেবে না। কি, মুখ শুকিয়ে গেল? আরে, কোনো ব্যাপারনা ! সব পেয়ে যাবে। গভীরে যাবার তো দরকার নেই! কে যাচাই করতে যাচ্ছে তোমার আসল ক্যালি? কিছু ছবি দেখে রাখবে। প্রচুর কফি-টেবল বই পাওয়া যায় । তাতে পাশে পাশে ছোট ছোট করে সার-সংক্ষেপ লেখা থাকে। দেশী ছবি দেখে লেখার সময়ে বিলিতি আরক মিশিয়ে দেবে। কেল্লা ফতে!
গান বাজনাও তাই। তবে এতে একটু সাবধানে মিশিও। এই এখনকার গান বাজনার ট্রেন্ড আমিও তেমন বুঝি না। কে যে কোত্থেকে ঝাড়ছে, কোনটা অজ্জিনাল আর কোনটা অনুপ্রাণিত ..বোঝা মুশকিল।
আমার তো বেশিরভাগ গানই GUN নি:সৃত বলে মনে হয় আজকাল। কথা, সুর...কিস্যুই বুঝি না। এই কেসটা একটু রয়ে সয়ে হ্যান্ডল কোরো। সেফ খেলা বেটার।<
এবার সাহিত্য। এখানেও ওই। দেখবে অনেক কিছু দুর্বোধ্য। আধুনিক গদ্য, পদ্য, নাটক। সেই কমলকুমার, বিষ্ণু দে ..আমি তো এঁদের লেখাপত্তর বুঝতেই পারলাম না। এমন আরও অনেকেই আছেন। তবে সেদিকে হুট করে কিছু বলে বোসো না যেন। যেটা বুঝবে না, বলবে, তুমি পৌঁছতে পারোনি ওঁদেরচিন্তার গভীরতার কাছে ।
মনে রাখবে ঠিকঠাক নিজেকে তৈরী করে নিতে পারলে তোমার বাজার তুঙ্গে। অনেকের কাছেই তখন তুমি কিংমেকার।তোমার দু ছত্তর প্রশংসা পাওয়ার জন্য তারা মরীয়া।তবে তার জন্য তোমাকে সেরকম পার্সোন্যালিটি তৈরী করতে হবে।
দেশী বিদেশী বই ...কী বললে? অত বই পড়তে পারলেতো তুমি দিগগজই হয়ে যেতে? আরে রাম রাম..বই পুরোটা পড়বে কেন? কিছু নাম ধাম জেনে রাখবে, কিছু দেশী -বিদেশী বইয়ের ব্লার্ব পড়ে রাখবে।
যেগুলো মনে রাখতে পারবে না, তোমার নোটবুকে, মানে ওই হরিদাসের গুপ্তখাতায় নোট করে রাখবে।
এদের মধ্যে যার লেখা ভালো লাগবে না,একেবারে ঘচাং ফু করে দেবে। আর যাদের লেখা ভালো লাগবে, তাদেরকেও কিন্তু কাছাখোলা প্রশংসা কোরো না। রেখেঢেকে বলবে। এই ধর বলবে, "হুম , ভালোই । তবে আরও পরিমার্জনের প্রয়োজন । " হড়বড় করে প্রশংসা করলে তোমার সমালোচক হিসেবে টি আর পি পড়ে যাবে। তোমাকেও তো নিজের দিকটা দেখতে হবে ! এতে করে দেখবে তোমার কৃপাদৃষ্টির জন্য বাবু বিবিরা হন্যে হয়ে ঘুরছে।
--আজ্ঞে, আমি তো কিছুই পারি না। লিখতে, গাইতে, আঁকতে, ছবি করতে ...
-- সেই জন্যই তো তুমি সমালোচক হবে। উচ্চমেধার জ্ঞানী সমালোচক হতে পারেন হাতে গোনা ক-জন। তাঁদের মেধা অবিসংবাদিত। তাঁদের সমালোচনার ধরনও আলাদা। সে তোমার দ্বারা হবার নয়। কাজেই তুমি হবে সেই সব সমালোচকদের একজন, যাদের বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে, এলেম নিয়ে লোকেকোনো কোনো সময়ে ;সন্দেহ করলেও তেড়েফুঁড়ে উঠে কিছু বলতে পারবে না । কারণ তোমরা এত আটঘাট বেঁধে খেলো, যে তাতে ভ্রান্তি বা অল্পবিদ্যা ঢাকা পড়ে যায় লেখনীর চাতুর্যে। সমালোচনার জগতে তোমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেখো, একেবারে আকাঠ সমালোচক হলে তার মূর্খতা লোকেরহাসির খোরাক হয়। কিন্তু এই তোমার মতো সমালোচক যারা, তারা এমন বিভ্রম উদ্রেককারী যে তাদের কেপেবিলিটির দিকে আঙুল তোলার আগে লোকে দু-বার ভাবে। এবার বল, এই লাইন কি তোমার পছন্দ? তাহলে আরও কিছু টিপস দিই। আর টাকাটা নিয়ে রসিদ কাটি। কাল থেকেই আসবে। একমাসের তালিম ।
দেবেশ হাত কচলিয়ে বলল,
-স্যার, আমাকে আশীব্বাদ করুন যেন জন্ম জন্মান্তরে আমি এই পেশাতেই থেকে যেতে পারি।
বিধাতা স্মিত হেসে ডান হাতটি তুলে বরাভয়ের ভঙ্গিতে বললেন,
--তথাস্তু ।