No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    তারাশঙ্কর আলাপ করালেন নসুবালার সঙ্গে, চিনতে পারলেন কি তপন সিংহ? 

    তারাশঙ্কর আলাপ করালেন নসুবালার সঙ্গে, চিনতে পারলেন কি তপন সিংহ? 

    Story image

    মাইলের পর মাইল হাঁটছেন তারাশঙ্কর। সঙ্গে তপন সিংহ এবং অন্যরা। অন্যরা বলতে সবাই ইউনিটের লোক। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ সিনেমা হবে শুনেই খুশিতে চোখ চকচক করে উঠেছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরিচালক তপন সিংহকে বলেছিলেন, এই ছবির লোকেশন বাছাইতে তিনি থাকবেন। থাকতেই হবে যে। উপন্যাসের পটভূমি বীরভূমের লাভপুর। সেখানেই কোথাও একটা হাঁসুলীর মতো বাঁক নিয়েছে ‘কাহার কন্যের’ মতো নদী কোপাই। সেই বাঁকের পাশেই বাঁশবাদী গ্রামে কাহারদের বাস। এই অঞ্চল ও তার চরিত্রদের সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা কি চাট্টিখানি কথা! তারাশঙ্কর এই লাভপুরকে যে হাতের তালুর মতো চেনেন। 

    তপন সিংহকে তারাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘জানো তপন, এই লাভপুরের আশেপাশে পাঁচ-ছখানা গ্রামে ক’খানা গাছ আছে, তা’ও বলে দিতে পারি আমি।’’ অতএব, তাঁর নেতৃত্বেই বাকিরা চলল সিনেমার লোকেশন দেখতে। লাভপুরে মাইলের পর মাইল হাঁটছেন তারাশঙ্কর। ক্লান্তির কোনো চিহ্নই নেই তাঁর চেহারায়। ইউনিটের বাকিরা হাঁপিয়ে পড়ছেন তাঁর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে। ওই যে, সিনেমার শুরুতেই পালকি বহনের দৃশ্য। ঢেউ খেলানো প্রান্তরে জল পেরিয়ে ছুটে আসছে পালকি বাহকের দল আর আবহে শোনা যাচ্ছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরারোপিত গানের অংশ। তার লোকেশন ঠিক হল। এরপর একে একে সিনেমার বাকি অংশের লোকেশনও। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ তারাশঙ্করের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। তা নিয়ে লেখকের আবেগও যে কিঞ্চিৎ বেশি হবে,স্বাভাবিক।

    এ তো শুধু লোকেশন খোঁজা নয়, সিনেমার প্রয়োজনে চেনা লাভপুরকেই যেন নতুন করে আবিষ্কার করছিলেন তারাশঙ্কর। খুঁজতে খুঁজতে মগ্ন হয়ে যেতেন। তাঁর দৃষ্টি চারপাশের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কোথায় ছুট লাগাত। সেই কোপাই, তার পাশে ইতি-উতি জুড়ে থাকা গ্রাম, আদিবাসী মানুষ। তারাশঙ্কর এঁদের সবাইকে কতকাল ধরে চেনেন। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ানোর পর সন্ধেয় লাভপুরের বাংলোয় বসত আড্ডার আসর। তপন সিংহকে মহাভারতের গল্প শোনাতেন তারাশঙ্কর। এমনই এক দিন তাঁদের সামনে এসে হাজির নসুবালা। ‘হাঁসুলী বাঁক উপকথা’-র “গোঁফকামানো মুখ, মেয়েদের মত ভঙ্গিতে ঘেঁড়া ময়লা শাড়ি পরা, মাথায় খোপা বাঁধা, হাতে চুড়ি নোয়া শাখা পরা” সেই নসুবালা। উপন্যাসে সে করালীর তুতো ভাই।

    তপন সিংহ লিখছেন, “হঠাৎ এক জন বৃদ্ধা এসে তাঁকে প্রণাম করল।...‘কেরে নসু নাকি... আয় আয়।’ সাদরে আহ্বান জানালেন তারাশঙ্কর। ‘হ্যাঁ বাবু, ভাল আছেন তো?’ বৃদ্ধাটি বলল। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে কেমন যেন মনে হল। তারাশঙ্কর আমার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে এই বাবু এসেছেন, তোদের নিয়ে সিনেমা করতে।’ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ হচ্ছে হাঁসুলিবাঁকের উপকথা-র নসুবালা। এ বার ভাল করে দেখলাম— যাকে বৃদ্ধা ভেবেছিলাম সে আসলে একজন পুরুষ। .... নসুবালা নাচে, গান গায়, তামাক খায়, মদ খায়, ঢোল বাজায়।... হঠাৎ তারাশঙ্কর বললেন, ‘এই নস্যে, বাবুকে একটা গান শোনা।’ কানে এক হাত দিয়ে দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে নসুবালা শুরু করলে— ‘‘আহা—আমায় এ হিদি মাঝারে আঁকা হয়ে গেলা শ্যামের চরণখানি।’’’’

    উপন্যাসের পাতা থেকে নসুবালাকে এভাবেই চোখের সামনে জীবন্ত উঠে আসতে দেখেছিলেন তপন সিংহ। নসু জন্মশরীরে পুরুষ, অথচ আদতে নারী। উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯৪৭, আর এই সিনেমার প্রস্তুতি যখন চলছে তখন ষাটের দশকের শুরু। লিঙ্গ-যৌনতার পাঠে সে’সময় প্রায় শিশু আমাদের দেশ। ‘রূপান্তরকামী’, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-র মতো শব্দগুলির জন্মই হয়নি। অত্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক ঘেরাটোপে বন্দি বাংলা সাহিত্যের মধ্যেই কীভাবে যেন চলে এসেছিলেন নসুবালা। তারাশঙ্কর তাঁকে সামান্যও বদলাননি, অসম্মান করেননি। নিজের উপন্যাসের সেই পৃথিবীটাকেই পরিচালকের সামনে উজাড় করে দিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। সেই পৃথিবী থেকেই ‘নসুবালা’ হঠাৎ ফের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তপন সিংহ-র। তপন সিংহ তাঁকে দেখলেন অবাক হয়ে, উপন্যাসের পর বাস্তবেও, অথচ চিনতে পারলেন কই!

    চিনতে পারলে সিনেমায় নসুবালা চরিত্রটিকে মেয়ে হিসেবে কেন দেখালেন তপন সিংহ? তারাশঙ্কর সিনেমার নসুবালাকে দেখে কী বলেছিলেন জানা নেই। জানা নেই, এই সিনেমা কখনো দেখেছিলেন কিনা বাস্তবের নসুবালা! দেখলে কী ভেবেছিলেন তখন, জানা নেই তাও। “এই যে এই বাবু এসেছেন, তোদের নিয়ে সিনেমা করতে’’—কথাটা কি তখন মনে পড়েছিল তাঁর। উত্তর পাওয়ার জো নেই। আমরা শুধু জানি, পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন তপন সিংহ। তখন আফসোসের শেষ ছিল না তাঁর।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @