মিনিয়েচার গাড়ি বানিয়ে ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস-এ তমলুকের অনির্বাণ মিশ্র

আমাদের চারপাশের যা কিছু, বাড়ি, ঘর, গাড়ি- সবকিছু যদি হঠাৎ ছোটো হয়ে যায়? খেলনার থেকেও ছোটো, কয়েক মিলিমিটারের? বিস্ময়, বিভ্রম আর ভালোলাগা- সবকিছু এক হয়ে অদ্ভুত এক মোহিনী আবেশ তৈরি হয় মনে। এমন গল্প দেশ-বিদেশের বেশ কিছু রূপকথায় বর্ণিত রয়েছে। আর অনেক শিল্পী রয়েছেন, যাঁরা বাস্তবে সেই রূপকথাকে সত্যি করে তোলেন। যা আকারে বা বহরে মানুষের থেকে অনেক বড়ো, বা যাকে সহজে ছোঁয়া যায় না, তার প্রতীকী ক্ষুদ্র রূপ শুধু শিল্প নয়, বোধহয় শিল্পের থেকেও বড়ো। তেমনই এক শিল্পী হলেন অনির্বাণ মিশ্র (Anirban Mishra), যাঁর হাতের ছোঁয়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মডেলগুলি বাস্তবের দ্যোতক হয়ে ওঠে। সেই নিঁখুত শিল্পকর্মের জন্য বেশ কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি সম্ভবত এশিয়া বুক অফ রেকর্ডস-এ আর ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস-এ স্থান পাওয়া।
যে গাড়ির মডেলটির জন্য ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসে স্থান পেয়েছেন অনির্বাণ
জীবনের ব্যস্ততা আর ইঁদুরদৌড়ের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে শান্তি, একান্ত যাপনের সময়। নিজের ছবির মাধ্যমে সেই একান্ত যাপন, সেই প্রায় নিরুদ্দিষ্ট শান্তিকে খোঁজেন তিনি। তাঁর কথায়, “যাঁরা আমার আঁকা ছবি কেনেন, অনেকে আমাকে বলেছেন যে, কাজ থেকে ফিরে আমার ছবি দেখলে তাঁরা যেন সেই শান্তিকে, সুস্থিরতাকে খুঁজে পান। এটাই আমার সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।”
পুর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের ভূমিপুত্র অনির্বাণের পড়াশোনা কলকাতার ইন্ডিয়ান কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড ড্রাফটম্যানশিপ থেকে। তারপর পড়েছেন হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি থেকে। বর্তমানে কলকাতার একটি কোম্পানিতে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত। বঙ্গদর্শন.কম-কে অনির্বাণ জানান, “আমি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছি। কিন্তু ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি এগুলোর প্রতি প্যাশন ছিল ছোটোবেলা থেকেই। তাই গ্র্যাজুয়েশনের জন্য আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম।” তিনি ২০১৬ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত, দেশ-বিদেশ মিলিয়ে প্রায় ৪০টি প্রদর্শনী করেছেন। মুম্বাই, কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, সান ফ্রানসিসকো, মন্ট্রিয়াল, পোর্টল্যান্ড বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। পেয়েছেন বহু স্বীকৃতি এবং পুরস্কার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কার হল- ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডে স্থান পাওয়া (২০২০), এশিয়া বুক অফ রেকর্ডে স্থান পাওয়া (২০২০), জলন্ধরের চতুর্থ রাজেশ্বরী কলা মহোৎসব-এ পুরস্কৃত হওয়া (২০২০), ইমার্জেন্ট আর্ট স্পেস সংস্থা আয়োজিত বিশ্বব্যাপী একটি পেইন্টিং প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান পাওয়া (২০২৩), ইমার্জিং আর্ট স্পেস আয়োজিত ডিজিটাল পেইন্টিং-এর সিরিজে স্থান পাওয়া (২০২৩) প্রভৃতি।
শিল্পী অনির্বাণ মিশ্র
অনির্বাণ মিনিয়েচার আর্ট-এরও একজন দক্ষ শিল্পী। এই দক্ষতাই তাঁকে এশিয়া বুক অফ রেকর্ডস আর ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস-এ স্থান এনে দিয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই তিনি কাগজ, মাউন্টবোর্ড দিয়ে বিভিন্ন মডেল বানাতেন। অনির্বাণ বলেন, “আমার গাড়ির শখ রয়েছে। তাই বিভিন্ন গাড়ির মডেল বানাই। আগে বড়ো আকারের মডেল বানাতাম। তারপর মিনিয়েচার মডেল বানাতে শুরু করি।” প্রথমে এমসিল জলের পাইপ দিয়ে একটি গাড়ির মডেল বানিয়েছিলেন। সিমকার্ডের ট্রে আর রেডিওর ভাঙা অংশ দিয়ে ২ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের মিনিয়েচার গাড়ির মডেল তৈরি করেছিলেন। এরপর কাঠ দিয়ে একটি একটি ১ ইঞ্চির গাড়ির মডেল বানিয়েছিলেন অনির্বাণ। আর যে গাড়ির মডেলটির জন্য এশিয়া বুক অফ রেকর্ড আর ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডে স্থান পেয়েছেন, সেটির দৈর্ঘ্য ৬ মিলিমিটার। গাড়িটি কাঠের, আর চাকাগুলি পোস্ত দানা দিয়ে তৈরি। মাউন্টবোর্ড দিয়ে টাইটানিক আর পাইরেট শিপের মডেল বানিয়েছেন। বালির বিভিন্ন আকারের পাথর, আঠা দিয়ে জুড়ে বিভিন্ন পশুপাখির মডেল তৈরি করেন। অনির্বাণের কথায়, “আমি পাথরগুলি কাটিং বা কার্ভিং করি না।” বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি করেন পেন। এছাড়া কোভিডের সময় চারকোল, ফুলের নির্যাস থেকে রং তৈরি করেছেন। সেই রং দিয়ে ছবিও এঁকেছেন।
পাথর দিয়ে তৈরি মাছের মডেল
তিনি আদতে চিত্রকর। পড়াশোনাও চিত্রকলা নিয়ে। তাঁর ছবির মূল বিষয়বস্তু কী? অনির্বাণ জানান, “আমাদের ব্যস্ততম জীবনে আমরা আসলে খুব একা। আমি নিজের আঁকা ছবিতে সেই একাকীত্বকেই ধরার চেষ্টা করি। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটকেও তুলে ধরার চেষ্টা করি। ২০২১ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল আমার মূল বিষয়।” তবে নিজের কাজের বিষয় সম্প্রতি একটু বদলেছেন। জীবনের ব্যস্ততা আর ইঁদুরদৌড়ের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে শান্তি, একান্ত যাপনের সময়। নিজের ছবির মাধ্যমে সেই একান্ত যাপন, সেই প্রায় নিরুদ্দিষ্ট শান্তিকে খোঁজেন তিনি। তাঁর কথায়, “যাঁরা আমার আঁকা ছবি কেনেন, অনেকে আমাকে বলেছেন যে, কাজ থেকে ফিরে আমার ছবি দেখলে তাঁরা যেন সেই শান্তিকে, সুস্থিরতাকে খুঁজে পান। এটাই আমার সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।” এছাড়া অন্যান্য বিষয় নিয়েও ছবি আঁকেন অনির্বাণ। নিজেই জানালেন, তাঁর ছবি মূলত শহরকেন্দ্রিক আর ল্যান্ডস্কেপ জাতীয়। আর প্রিয় শিল্পী? অনির্বাণের উত্তর, “ডেভিড হফনি, এডওয়ার্ড হফার, সুধীর পট্টবর্ধনের কাজ আমার খুব পছন্দের।” এক্সপ্রশনিজম, স্যুররিয়ালিজম থেকে অনুপ্রাণিত হন অনির্বাণ। তাঁর ছবিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় ইউরোপিয়ান রঙের প্যালেট আর জলরং। ইউরোপিয়ান রঙের প্যালেটের গাঢ় নীল, বাদামী, ধূসর রঙের ব্যবহারে জীবনের বিভিন্ন দিককে ফুটিয়ে তোলার কাজ তাঁর কাছে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। করেন ফটোগ্রাফির চর্চাও।
অনির্বাণ নিজের তৈরি মডেল পাঠিয়েছিলেন গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এও। সেটি ছিল একটি ১ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের গাড়ির মডেল। সেই প্রজেক্টটি গৃহীত হয়েছিল বলেও জানালেন অনির্বাণ। “কিন্তু তারপর কাজের বিভিন্ন ভিডিও, ছবি, পাঠাতে হয় সেখানে। সেই ছবি, ভিডিওর অনেকগুলি মানদণ্ড থাকে। তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি”, বলার সময় যেন কিছুটা হতাশা ধরা পড়ছিল অনির্বাণের গলায়। পরমুহূর্তেই হতাশা বদলে গেল দৃঢ়তায়, “ভবিষ্যতে আবার পাঠাবো নিজের তৈরি মডেল।” তাঁর চ্যালেঞ্জ নিতে ভালো লাগে, ভালো লাগে নতুন পথের সন্ধান করতে। সেই ভালোবাসা থেকেই অনির্বাণ ছবির মধ্যে খুঁজে চলেছেন একাকীত্বের মধ্যে শান্তিকে, আর তাঁর তৈরি মডেলের মাধ্যমে বিশালত্ব প্রতিফলিত হচ্ছে ক্ষুদ্রত্বে।
**ছবিঋণঃ অনির্বাণ মিশ্র