পুজো-মণ্ডপের বাইরে বেরিয়ে বাংলার ঢাক যখন বিশ্বজনীন

দুর্গাপুজোর রেশ এখনও কাটেনি। এখনও বাতাসে ঢাকের বোল আর তার অনুরণন। পুজো শেষে আমরা অনেকেই ভাবি ঢাকের বাদ্যির এই মনকাড়া তাল শোনার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও একটি বছর। তাই কি? ঢাকের বোল কি তার আগমনী-বিজয়া ছন্দের বাইরে বেরোতে পারে না?
গত দশকের শুরুর দিকে, ২০০২-০৩ সালে, কলকাতার আহিরীটোলাতে আয়োজিত এক ঢাক প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলার প্রখ্যাত তবলা-শিল্পী তন্ময় বোস। সেখানে অসংখ্য প্রতিযোগীর মধ্যে তন্ময়বাবুর মন কেড়ে নিতে পেরেছিলেন একজনই— পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার মসলন্দপুরের বাসিন্দা গোকুলচন্দ্র দাস। বিমুগ্ধ তন্ময়। গোকুলচন্দ্র দাসকে শুধুমাত্র বিজয়ী ঘোষনাই করলেন না, দুর্গাপুজোর পর তাঁকে যোগাযোগও করতে বললেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, গোকুলই সেই ব্যক্তি, যাঁর মাধ্যমে তিনি একটি বিশেষ পরিকল্পনাকে একটু একটু করে বাস্তবায়িত করতে পারবেন। সেই স্বপ্নের নাম বাংলার ঢাককে মূলধারার বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে মেলে ধরা।
চক্ষুদান (গোকুলচন্দ্র দাস)
আজও এই ঢাকের বাদ্যি প্রধানত দুর্গাপুজোর সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে। যেন ঢাক পৃথিবীর একমাত্র 'মরশুমি' বাদ্যযন্ত্র। এমন হওয়ার কথা তো নয়! বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ও নিজস্ব তালযন্ত্র কেন একটি বিশেষ উৎসবের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না? এর কোনো স্পষ্ট উত্তর আমাদের কাছে নেই, কিংবা উত্তর কখনও খুঁজিনি। তবু আমরা কৃতজ্ঞ থাকব তন্ময় বোসের 'তালতন্ত্র' নামের তাল-ছন্দ-লয় ঐক্যতানের কাছে, যেখানে গোকুলচন্দ্রের ঢাক বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানের মঞ্চে সম্মানের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ধন্যবাদ জানাতে হয় আহিরীটোলায় আয়োজিত সেই ঢাক-বাদন প্রতিযোগিতাকে, যেখানে গোকুলচন্দ্র গুরু হিসাবে পেয়েছিলেন তন্ময় বোসকে। তারপর গুরু পথ দেখালেন। বোঝালেন, ভারতীয় ধ্রূপদী যন্ত্রসংগীতের কঠিন বোলগুলিকে ঢাকের বাজনাতে রূপ দেওয়া কীভাবে সম্ভব। যাতে কোনো সংগীতানুষ্ঠানে সঙ্গত হিসেবে ঢাককেও ব্যবহার করা যেতে পারে। বিষয়টি এখানেই থেমে যায়নি। শ্রদ্ধেয় বোসের স্বপ্নের পথ ধরেই গোকুলচন্দ্র ভারত এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবদন্তি শিল্পীদের পরিবেশনায় সঙ্গত করেছেন।
পুজো (গোকুলচন্দ্র দাস)
যেমন, ২০০৯ সালে দ্য আইকনিক হলিউড বোল-এ পণ্ডিত রবি শঙ্করকে সঙ্গত দিয়েছেন। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত দ্য মাস্টার্স অফ পারকাসন ট্যুর-এ জাকির হুসেনকে সঙ্গত দিয়েছেন। এছাড়াও উস্তাদ আমজাদ আলি খাঁ এবং কত্থক নৃত্যশিল্পী স্নিগ্ধা মিশ্রের সঙ্গেও কাজ করেছেন গোকুল। শুধু তাই নয়, ঢাককে তিনি নারী-ক্ষমতায়নের বিশেষ মাধ্যমে পরিণত করেছেন। যার ফলে গোকুলচন্দ্র দাস ও তাঁর মহিলাবাহিনী সৃষ্টি করেছেন প্রথাগত ধ্যানধারণার বাইরে একটি লম্বা-চওড়া পথ।
পণ্ডিত বোসের মতো ব্যক্তিত্ত্বের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করায় গোকুলের চোখে-মুখে-কথায় গুরুর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তাঁর মতে, “একতাল, ঝাঁপতাল, ধামার (সবই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারা), যা-ই আপনি ঢাকে চাইবেন, বাজাতে পারবেন। যন্ত্রসংগীতই হোক বা কণ্ঠসংগীত, ঢাকের মাধ্যমে যোগ্য সঙ্গত করা সম্ভব।" তিনি আরও বলেন, "অথচ এগুলি কেউই শেখান না। যে সমস্ত ঢাকিরা পুজো মণ্ডপে ঢাক বাজাচ্ছেন, তাঁরা তাঁদের বাপ-কাকাদের কাছে শিল্পের প্রাথমিক শিক্ষাটাই পেয়েছেন। কিন্তু এভাবে বেশিকিছু করা সম্ভব নয়। ঢাকি হওয়ার জন্য কেউ কিন্তু তেমন কোনো প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যান না। কিন্তু লোকে তবলা বা পাখোয়াজ বাজানো শেখেন।”
গোকুল দাস নিজে প্রাথমিক তালিমের বাইরেও অনেককিছু শিখেছিলেন তাঁর বাবা মোতিলাল দাসের কাছে। মোতিলাল দাস ওরফে মোতি ঢাকি ছিলেন তাঁর সময়ের একজন কিংবদন্তি শিল্পী, যিনি আমাদের পরিচিত দুর্গাপুজোর ঢাকের বাইরেও অনেক বেশি নিজস্বতা দেখাতে পারতেন। গোকুলের ঢাক বাজানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা উত্তরাধিকার সূত্রেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পণ্ডিত তন্ময় বোসের সাহচর্য।
আজ ধন্যবাদ জানাতে হয় মসলন্দপুর মোতিলাল ঢাকি.কম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে, যা রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে ২০১৩ সালে। ঢাক বিষয়ক সচেতনতা এবং তার বহুমুখী প্রয়োগ ছড়িয়ে দিচ্ছেন ১৩ থেকে ৫০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে। শুধুমাত্র ঢাক নয়, পাশাপাশি গিটার, স্যাক্সোফোন এসব বাদ্যযন্ত্রও নিজে বাজান। আনন্দের খবর হল, তিনি একটি জমি নিতে পেরেছেন, যেখানে নির্মিত হবে বাংলার সর্বপ্রথম ঢাকবাদন প্রশিক্ষণ স্কুল। ঢাক বাজিয়ে দিন গুজরান করা সম্ভব হত না বলে একসময় যাঁকে হাবড়া স্টেশনের কাছে একটা ছোটো দোকান খুলতে হয়েছিল, তাঁর কাছে এটি অবশ্যই স্বপ্নের বিষয়।
বিসর্জন (গোকুলচন্দ্র দাস)
ঢাককে তিনি আরও জনপ্রিয় করে তুলেছেন মহিলা ঢাকিদের মাধ্যমে। এমন পরিকল্পনা তাঁর মাথায় আসে ২০১০ সালে। নিজেই জানাচ্ছেন,
এক মাস পর দেশে ফিরে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে ছাত্রী খোঁজা শুরু করলেন। জোগাড় করলেন ছয় জনকে। এক দশক পর সেই সংখ্যা পৌঁছে গেল আশিতে। শুরুতে মেয়েদের বাড়ি থেকে আপত্তি থাকলেও পরবর্তীতে সবকিছু অতিক্রম করেছেন মেয়েরা। তাঁদের বেশিরভাগই এখন দক্ষ ঢাকি। যাঁরা আমন্ত্রণ পেয়ে ঘুরে বেড়ান পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত।
মুচকি হাসেন গোকুল দাস। বলেন, “ওঁরা সকলেই এসেছেন অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে। অধিকাংশই দেখেছেন ঢাক বাজাচ্ছেন বাড়ির পুরুষরা। এখন কিন্তু ঢাকি হিসেবে তাঁরাও অধিক সম্মান পাচ্ছেন।”
এবছর যেমন কলকাতার বিখ্যাত সুরুচি সঙ্ঘের পুজোতে দশজন ঢাকির যে দলটিকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছয় জনই ছিলেন মহিলা। একইভাবে, বাগবাজারের এক পুজোর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় আটজন মহিলা ঢাকিকে। গর্বের সুরে গোকুলচন্দ্র দাস জানান, “আমার এই উদ্যোগকে অনুসরণ করে শুধু মসলন্দপুরেই এখন ছয়-সাতটি মহিলা ঢাকির দল রয়েছে। তাঁদের প্রত্যেককে পথ দেখাতে পেরে আমি গর্বিত।”
এখন পুজো ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বা সমাপ্তিতেও ঢাক বাজানোর প্রচলন শুরু হয়েছে। কোভিড মহামারী কাটলে আশা করা যায় আবার মণ্ডপ এবং মণ্ডপের বাইরেও আমরা ঢাকের বাদ্যি শুনতে পাব। আমাদের মন কি তখন একটিবারের জন্যও নেচে উঠবে না?