No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ইসলামি সংস্কৃতিতে বাঙালির হৃদয় ভিজেছে

    ইসলামি সংস্কৃতিতে বাঙালির হৃদয় ভিজেছে

    Story image

    চিৎপুর অঞ্চলের এ হাতায় নাখোদা বড় মসজিদ। পশ্চিমে গঙ্গা পানির শ্রোত উজান দেয়। পূর্বে ফলপট্টির আম দরবারি বেঁচা-কেনা। বেনারসি জরদা মুখে পুরে নিলামদার নিলাম ডাকে ফল-ফলারির। মুশকিল আসান ঘোরে এ মাথা ও মাথা । সেই হাজার ফলের মহল্লায় খেজুর, আপেল, আঙুর, সবেদা আর আনারসের কাবুলি সুবাস বাতাসে ম-ম করে। বলতে গেলে আরব্য রজনীর এ দেশে যেন সদর মোকামের বাতি জ্বলে। সঙ্গ রসনায় বাদশাহি খানা-পিনার রাজকীয় ভারত নামা দোকান ঘর।

    চিৎপুর রাস্তার মাঝখানে ট্রাম গাড়ি পথের দুই পার জুড়ে হেকিমি দাবা খানা, নকশাদার গালিচা, এক ফালি জরি সুতোর দর্জিপাড়া, পাঞ্জাবি, আলীগড় পাজামা সেলাই কল অথবা জুঁই, গোলাপ আর খাশ আতরের বাক্স হাতে আলি মিয়াঁদের ঘোরাঘুরি। ওয়াক্তের সময় ধরে শোনা যায় নামাজ। আজান পড়া হয়। তারই মাঝে এক পুঁথি-পত্রের ছোট্ট দোকান ঘর গাওসীয়া লাইব্রেরি।

    বড় হুজুরের দরবার, লায়লা-মজনুর গোলাপ-কাঁটা ভালোবাসা, নামাজ পড়ার নিয়ম- কানুন আর সাথে সঙ্গ দিচ্ছে আরও অনেক পুঁথি। যেমন আদি ও আসল ছোলেমানী তালেনামা, গাজি-কালু চম্পাবতি, ইউছুফ জুলেখা, নুরনামা ও হুলিয়া নামা কিম্বা কারবালার ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ কাহিনীর পুঁথি মানে কারবালার মাতম জারি, আর বিশেষ করে ‘বোন বিবি জহুরা নামা’।

    ইসলামি পুঁথি পত্রের এ দোকানের নামের পরে ইংরেজি গন্ধ গা মেখে আছে। তাই শিরোনাম ‘গাওসীয়া লাইব্রেরি’। প্রাচীন এক ছোট্ট মহলা। ডাক বাক্সের ঠিকানা ৩০ নম্বর মদন মহন বর্মণ স্ট্রীট। ডাঁই করা বইয়ের ছোট বড় ইমারত দোকানের দেওয়াল বেয়ে মাথা তোলে। মলাটের গায়ে কিম্বা বইয়ের বুকে পিঠে উঁকি দেয় চাঁদ, তারা, খিলান, গম্বুজ কিম্বা মসজিদের নানা নকশা। লাল, সবুজ হলুদ বা গোলাপি রঙের ইরানি বাহারে চোখের হাতছানি সামলানো ভার।

    সেই যবে থেকে বাদশা, উজির নাজির-রা দেশের শাসন নিলো তবে থেকেই ইসলামি সংস্কৃতিতে বাঙালির হৃদয় ভিজেছে। মালঞ্চ ঘেরা বাগানে ভ্রমরের গুণ গুণ শেখার পাশা পাশি বাঙালি নিজের নিজের মতো করে ‘বাগিচায় বুলবুল’ বলতে শিখেছে। ভাই গিরীশচন্দ্র সেন অনুবাদ করেছেন পবিত্র কোরাণ। বাঙালি মেয়ের শরীরে উঠেছে আতরের সুবাস আর ডাগর চোখে টান পড়েছে সুর্মা - র। বাঙলা সাহিত্যের তাজ মুকুটে ইসলামি ভাষার জয় নিশান উঠেছে। এসবেরই এক নীরব সাক্ষী এই গাওসীয়া লাইব্রেরি।

    গাওসীয়া লাইব্রেরি থেকে আজও প্রকাশিত হয় অতি দুর্লভ ‘বোনবিবি জহুরা নামা।’ হাজার মাইল দূরের ওই যে মধুর দেশ, বাঘের দেশ সুন্দর বন সেখানের দ্বার রক্ষী গাজিবাবা। আর সে বনের একমাত্র মালিক বোনবিবি। কি ভাবে তিনি গভীর জঙ্গলে দুখেকে রক্ষা করে ছিলেন সেই কাহিনী আজও ঘোরে বাদা বনের ঘরে ঘরে। কি হিন্দু কি মুসলমান বোনবিবির জহুরা নামা পাঠ না করে বনের দুয়ারে কেউ পা রাখেনি এতো দিন। সেই রীতি মানাই হল দস্তুর।

    আর সেই জহুরা নামা গাওসীয়া লাইব্রেরি থেকে বহুদিন ধরেই রেল পথে, নৌকো পথে পৌঁছে যাছে জঙ্গলের কানায় বাস করা মধু মাওলাদের হাতে কিম্বা গুণিনদের দরবারে অথবা সাধারণ মানুষের কাছে। সদর কলকাতার সুতোয় বাঁধা পরে সাত জেলিয়া, লাহিরিপুর, কাক মারি, ঝড় খালি মানে প্রায় গোটা সুন্দর বন।

    রীতি মেনেই বলতে হয় ‘আল্লা আল্লা বল সবে হয়ে এক মন/ বোন বিবির কথা এবে শোন সর্বজন….’

    এই সব পুঁথি সাহিত্যের চলন বা পাঁচালির ঢং- গাঁ বাংলার সাবেকি। লেখার অক্ষর বাংলা কিন্তু পড়ার ছকে পাতা ওলটাতে হয় ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে উর্দুর মতো। এ যেন একই বৃন্তের দুটি কুসুম।

    বিগত একশ বছর লাগোয়া এই বইয়ের দোকান তথা ছাপাখানা বাংলা ইসলামি সাহিত্যের এবং বটতলার সাহিত্যের এক প্রাণ কেন্দ্র। যা আজও বাঁচিয়ে রেখেছে অনেক অনেক প্রাচীন পুঁথির নির্ভেজাল রূপটিকে। বলতে বারন নেই যে স্বয়ং অবনীন্দ্রানাথও এক কালে খোঁজ করতেন এই সব ইসলামি  চিৎপুরী সাহিত্যের। যাই হোক আজও সেই গাওসীয়া লাইব্রেরি তার অবদান রেখে চলেছে আপন ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন পালন করে।

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @