তালচাঁচনি, তালচাঁচুনি বা তালঘষার মই : বাংলার লোকপ্রযুক্তির নিদর্শন

বাঙালি জাতি যেমন সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথের তাল ঠোকে, সেরকমই কৃষ্ণবর্ণ আষাঢ়ে ফলটির কথা উঠলেই বিভুতিভূষণের ‘তালনবমী’ গল্পের রেফারেন্স চলে আসে। তালনবমীর জন্য জটি পিসিমার কাছে যেচে পড়ে পাকা তাল বেচতে গিয়েছিল দুই ভাই নেপাল আর গোপাল। এমনিতে পয়সায় দুটো করে দিলেও পিসিমার জন্য নেপাল পয়সায় তিনটে করে তাল দিয়েছিল। দরাদরি শেষে জটি পিসিমা বলেছিল— ‘বেশ কালো হেঁড়ে তাল তো? আমাদের তালের পিঠে হবে তালনবমীর দিন— ভালো তাল চাই।’
যাঁরা ‘তালনবমী’ পড়েছেন, এ ঘটনা তাঁরা ভালো ভাবেই জানেন।
আটপৌরে যন্ত্রের বা প্রযুক্তির ব্যবহার যা সাবেক বাংলা থেকে এখনো অবধি চলে আসছে। আর সেইসব প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন মূলত বাংলার মায়েরা তথা গৃহিণীরাই।
শহরের বাজারগুলোতে এখন ৫০/৬০ টাকা দরে তাল কিনতে পাওয়া যায়। গেরস্ত ঘরের তুলনায় মিষ্টির দোকানের ক্রেতাই বেশি। দ্রুততার যুগে যা দেখা যাচ্ছে রেডিমেড তালের বড়া-ই শহরের মানুষের বর্তমান/ভবিষ্যৎ। তবে, এখনও বাংলার গেরামগঞ্জে তালের এটা ওটা রাঁধার সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে ধপাস করে তাল পড়াটাও দারুণ উপভোগ্য একটা ব্যাপার। যে যাই হোক, তালের বড়া বা অন্যান্য পদ করতে গেলে লাগে তাল। আর তাল ঘষার জন্যই একসময় বিশেষ কায়দার একটা যন্ত্র বানানো হয়েছিল। অঞ্চল ভেদে যেটি তালচাঁচনি, তাল-চাঁচুনি বা তালঘষার মই বলে পরিচিত। যা বাংলার মায়েদের প্রযুক্তি।
ছবি : দীপঙ্কর পাড়ুই
বাংলার মায়েদের প্রযুক্তি অর্থাৎ সেইসমস্ত আটপৌরে যন্ত্রের বা প্রযুক্তির ব্যবহার যা সাবেক বাংলা থেকে এখনো অবধি চলে আসছে। আর সেইসব প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন মূলত বাংলার মায়েরা তথা গৃহিণীরাই। এইসব প্রযুক্তি বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি-চর্যার শিকড়ে মিশে আছে। কলকাতার মেয়েদের জীবনের যেসব খুঁটিনাটি লোকচক্ষের আড়ালে চলে গেছে বা যাচ্ছে, তার মধ্যে রয়ে গেছে সামাজিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।
‘জষ্ঠি মাসে আম কাঁঠাল
আষাঢ় মাসে ইলিশ।
ভাদ্দর মাসে তালের তত্ত্ব
পুজোয় কুটুম পালিশ।।’
(সিধু ঘটকের ছড়া: থোড় বড়ি খাড়া, কল্যাণী দত্ত)
ভাদ্রমাসে বাঙালি রসুই ঘরে তাল অবশ্যই থাকবে। এই প্রসঙ্গে থোড় বড়ি খাড়া-তে কল্যাণী দত্ত বলছেন- ভাদ্র মাসে তালের বড়া, লুচি, তালের পোড়া পিঠে, ফুলুরি, তালক্ষীর আর বেয়াই বেয়ান লেখি দুটো কালো হেঁড়েল তাল।’ ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে বাংলার সধবা মহিলারা ‘তালনবমী ব্রত’ পালন করেন। নৈবেদ্য হিসাবে অন্যান্য ফলমূলের সঙ্গে তালের নানা পদ নিবেদন করা হয়।
খুবই সহজ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় ‘তাল-চাঁচুনি’ বা ‘তালঘষার মই’ নামের যন্ত্রটি। ত্রিভূজাকৃতি এই যন্ত্রের দুটি বাহু ২ ×২ ইঞ্চি পুরু, লম্বায় ৩০ ইঞ্চি থেকে ৪৫ ইঞ্চি মাপের। ঐ দুটি কাঠের বাহুকে একটি দিকে পেরেক দিয়ে জুড়ে নিতে হবে। দেখতে হবে তিনকোণা মানে ইংরাজী V আকৃতির মতো। অনেকে আবার H বা চৌকো আকৃতিরও বানিয়ে থাকেন। যন্ত্রের মাথার দিকে শক্ত লোহার পাত ব্যবহার করা হয়। V বা H আকৃতির মাঝের জায়গাগুলিতে লোহার বা অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি সামান্য মোটা ৮ থেকে ১০ টা পাত অর্ধচন্দ্রাকৃতি করে ১ ইঞ্চি বরাবর জোড়া থাকে। শেষে একটু শক্ত রড দেওয়া থাকে টানা দেওয়ার জন্য। এবার তাল চাঁচার পালা। যন্ত্রটি নিয়ে গামলার উপর রেখে তাল চাঁচা হয়। তারপর শুরু হয় হেঁশেলে তালের বড়া বানানোর ধুম।
তথ্যসূত্র:
থোড় বড়ি খাড়া, কল্যাণী দত্ত
বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়
দীপঙ্কর পাড়ুই, বঙ্গদর্শন আর্কাইভ