শবরদের স্বপ্নপূরণের কারখানা ‛স্বপ্নের স্কুলবাড়ি’

কথায় বলে, স্বপ্ন দেখার অধিকার, আর সেই স্বপ্নের পথে চলার অধিকার না কি সকলের। কিন্তু রূঢ় বাস্তব বোধহয় অন্য কথা বলে। সময় আর সমাজের কষাঘাতে অপদস্থ মানুষগুলোর ‛জীবন আসলে বাঁধা পাকস্থলীতে’। স্বপ্ন দেখা তো দুরস্থান, তার মানেও জানতে পারেননি তাঁরা, আদিগন্তকাল ধরে। কবির সুমন তাঁর গানের পংক্তিতে বলেছেন- “আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি, কার তাতে কি?” এই স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন দেখানোর দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে চলেছে শবর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট (Shabar Welfare Trust) পরিচালিত, শবরদের জন্য ‘স্বপ্নের স্কুলবাড়ি’। পুরুলিয়ার সিন্দরী গ্রামে, শবর উপজাতির বাচ্চাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে এই সম্পূর্ণ অবৈতনিক প্রতিষ্ঠান।
বঙ্গদর্শন.কম কথা বললো এই স্কুলবাড়ির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য স্বর্ণাভ দে-র সঙ্গে। তিনি বর্তমানে একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। তাঁর কথায়- “আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন আলাপ হয় আমার পাড়ার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে, যিনি মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যে কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গেই প্রথম আমি পুরুলিয়ার এই অঞ্চলে যাই, আর শবরদের সম্পর্কে জানতে পারি।”
কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রতি সপ্তাহে শনি-রবিবার ঐ অঞ্চলে যেতেন, বাচ্চাদের পড়িয়ে আবার ফিরে আসতেন। সেখানেই তাঁদের পরিচয় হয় শবরদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট শ্রী নির্মল প্রসাদ শবরের সঙ্গে। “মূলত ওঁর পরামর্শ ও সহায়তাতেই এই প্রতিষ্ঠানের ভাবনা আসে আমাদের মনে” বলছিলেন স্বর্ণাভ। চাকরি পাওয়ার পর শুরু হয় উদ্যোগ। স্যোশাল মিডিয়াতে ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে ২০ লক্ষ টাকার বেশি জোগাড় হয়ে যায়। গড়ে তোলা হয় শবর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। দলের নাম দেওয়া হয় ‘স্বপ্নের কারখানা’। পুরুলিয়ার সিন্দরী অঞ্চলে জমি কিনে ও স্কুলবাড়ি-হোস্টেল বানিয়ে ২০১৯ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে শুরু হয় স্কুলবাড়ির পথচলা। শুরুতে ২৫ জন শবর শিশুকে নিয়ে শুরু হয়েছিলো এই স্কুলবাড়ি, এখন সেখানে শিশুর সংখ্যা ৫২ জন। প্রথমে শুধুমাত্র ছেলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু হলেও, আগের বছর থেকে মেয়েদেরও এই প্রতিষ্ঠানের আওতায় আনা হয়েছে। ছেলে আর মেয়েদের জন্যে আছে আলাদা হোস্টেল।
কতটা কঠিন ছিলো ‘স্বপ্নের কারখানা’ পরিচালিত ‘স্বপ্নের স্কুলবাড়ি’ শুরুর যাত্রাপথ? স্বর্ণাভ বলেন “এ ধরনের কাজে কিছু বাধা তো থাকেই। আমাদের ক্ষেত্রেও এসেছিলো। অনেকে বিশ্বাসই করতে চায়নি যে এমন কোনও উদ্যোগ আদৌ সফল হতে পারে। তবে উল্টোদিকে অনেক মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সাহস দিয়েছিলেন, সাহায্য করেছিলেন। নাহলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ২০ লক্ষ টাকার বেশি জোগাড় করা সম্ভব হতো না। তাঁদের কথাই বেশি করে মনে রাখতে চাই।” আর যাদের নিয়ে, যাদের জন্যে এই কাজ, তাঁদের কেমন প্রতিক্রিয়া ছিলো? স্বর্ণাভ জানান- “এই মানুষগুলো সময়ের কাছে এতদূর হেরে বসে আছে, যে এরা দু’বেলা পেট ভরে খেতে পেলে আর কিছু চায় না। আমরা যখন গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে আমাদের এই উদ্যোগ সম্পর্কে কথা বলি, আর একথা জানাই যে বাচ্চারা স্কুলে পড়বে, একসঙ্গে থাকবে, অন্য কাজও শিখবে, তখন তাঁদের জিজ্ঞাস্য ছিলো একটাই-বাচ্চাগুলো খেতে পাবে কি না? আমরা সেই আশ্বাস দেওয়ার পর তাঁরা আর আপত্তি করেননি।” আর যেখানে বাচ্চারা আট-দশ বছর বয়স থেকেই কাজ শুরু করে দেয় কয়লা-খাদানে, সেখানে এই ধরনের সুযোগ তাদের কাছে ছিলো স্বপ্নের থেকেও বেশি।
শবরদের বঞ্চনা, হতাশা আর লড়াই ঐতিহাসিক ভাবে দীর্ঘ। ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ সরকার, ‘অপরাধপ্রবণ জনজাতি’-র তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিলো শবরদের। তারপর বীরসা মুন্ডা, লছু শবর, কোমটা মুন্ডাদের জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার পাওয়ার লড়াই ‘উলগুলান’ বুকে ধরে জন্ম নিলো স্বাধীন ভারতবর্ষ।
এই স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি চলে অন্য অনেক কাজকর্ম। বাচ্চাদের শেখানো হয় বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, শেখানো হয় বাগান তৈরি করা। বিভিন্ন সবজি তৈরি করা হয় স্কুল-লাগোয়া জমিতে। এইসব জিনিসপত্র বিক্রিও করা হয় রাজ্যের বিভিন্ন মেলায়। ছেলেমেয়েরা নাটক মঞ্চস্থ করে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। স্কুলে বসানো হয়েছে একটি টেলিস্কোপ। যার মাধ্যমে বাচ্চারা মহাকাশ সম্বন্ধে প্রাথমিক পাঠ পায়। একটি কালার টিভিও কেনা হয়েছিলো ফুটবল বিশ্বকাপের সময়। স্কুলের সামনে বিশাল মাঠে নিয়মিত চলে ফুটবল খেলা। স্কুলের নিজস্ব ফুটবল দল আছে, যারা রাজ্যের ছোটো বড়ো ফুটবল প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নেয়। বাচ্চাদের পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কলকাতা থেকে বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিয়মিত যান। পুরুলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষরাও নিযুক্ত রয়েছেন এই কাছে। এখানে পড়ান শবর মেয়েদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট রমনীতা শবর। স্বর্ণাভ আর তাঁর বন্ধুরাও কাজের ফাঁকে সেখানে গিয়ে পড়িয়ে আসেন। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের কাজের বদলে পারিশ্রমিক পান। এলাকার একটি স্কুলের মাধ্যমে বাচ্চাদের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
এই শবর-শিশুদের আরেকটা বড়ো সমস্যা হলো অপুষ্টি। স্বর্ণাভর কথায় জানা গেলো, যখন তাঁরা এই স্কুল শুরু করেন, তখন একেকজন ১০-১২ বছরের শিশুর গড় ওজন ছিলো ২০ কেজি, এখন নিয়মিত পরিচর্যার ফলে যা অনেকটাই বেড়েছে। স্বর্ণাভর কথায়- “আমার কাছে এইটাই স্কুলের সবথেকে বড়ো সাফল্য।”
কয়েকজন ডাক্তারকে নিয়ে প্রত্যেক মাসে করা হয় স্বাস্থ্যক্যাম্প। এছাড়া পুরুলিয়ার ঐ অঞ্চলের কিছু ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়, যাতে দরকারে তাঁদের সাহায্য পাওয়া যায়। সামনেই আছে একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তবে স্বর্ণাভ জানালেন, এখনও পর্যন্ত স্কুলের বাচ্চাদের বড়ো কোনো অসুখ হয়নি। কোভিডের সময় যখন সারা দেশে শুরু হয়েছিলো লকডাউন, তখন বন্ধ ছিলো এই হোস্টেলও। বাচ্চাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আর তাদের ঘরে ঘরে চাল-ডাল, তেল-মশলা প্রভৃতি পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।
তবে স্বর্ণাভদের উদ্যোগ শুধু স্কুলবাড়িতেই থেমে নেই। তাঁরা শবরদের গ্রামে গ্রামে চালাচ্ছেন একটি ভ্রাম্যমাণ প্রশিক্ষণকেন্দ্র- ‘স্বপ্নকুটির’। এখানে গ্রামের শিশুদের নার্সারি স্তরে পাঠদান করা হয়, আর তাদের বাবা-মায়েদের বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, সেলাইয়ের কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। স্বর্ণাভরা এবার পরিকল্পনা করছেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শবর গ্রাম বানানোর। যেখানে জামা-কাপড় থেকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র বানাবেন গ্রামবাসীরা, সেগুলি নিজেরাই ব্যবহার করবেন। বাড়তি জিনিস বাইরে বাজারে বিক্রি করা হবে। স্বর্ণাভ জানালেন, এই কাজের জন্য পুরুলিয়ার কুদা নামের একটি শবর ডিহি অর্থাৎ শবর গ্রামকে বেছে নেওয়াও হয়েছে। এই গ্রামে বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুদের দত্তক নেওয়া হবে, বিভিন্ন কাজে প্রশিক্ষিত করা হবে।
প্রসঙ্গত, শবরদের বঞ্চনা, হতাশা আর লড়াই ঐতিহাসিক ভাবে দীর্ঘ। ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ সরকার, ‘অপরাধপ্রবণ জনজাতি’-র তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিলো শবরদের। তারপর বীরসা মুন্ডা, লছু শবর, কোমটা মুন্ডাদের জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার পাওয়ার লড়াই ‘উলগুলান’ বুকে ধরে জন্ম নিলো স্বাধীন ভারতবর্ষ। কিন্তু শবরদের গায়ে পরাধীনতার শেকলের দাগ আজও দগদগে, যেখানে রোজ জন্মায় নতুন ক্ষত। কর্পোরেটদের হাত থেকে জমি বাঁচানোর লড়াই। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে লড়াই। অস্পৃশ্যতা থেকে বেরিয়ে আসার লড়াই। তবে শোষণ যেমন অক্লান্ত, পাল্টা লড়াই তেমনই অক্লান্ত। ১৯৬৮ সালে নন্দলাল শবর গড়ে তোলেন খেড়িয়া-শবর উন্নয়ন সমিতি। লড়াই শুরু হয় নতুন করে। আজও সময় তার পাত্র থেকে ঢেলে যাচ্ছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। সেই অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের জল-জমি, শিক্ষা, স্বাস্হ্য, সামাজিক অধিকারের জন্য আরেকবার কষে কোমর বাঁধছে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত মানুষগুলো। নন্দলালদের লড়াইকে এগিয়ে যাচ্ছেন নির্মল প্রসাদ, রমনীতারা। এমন সময়ে স্বর্ণাভদের এই উদ্যোগ নতুন করে ভরসা দেয়, নতুন করে বিশ্বাস করতে শেখায় জীবনে। শালবনের মাথা ছুঁয়ে বয়ে চলা মেঘের ভিতর থেকে ভেসে আসে সমবেত গান- “we shall overcome” আর “গাঁও ছোড়াব নাহি, জঙ্গল ছোড়াব নাহি, মায়-মাটি ছোড়াব নাহি, লড়াই ছোড়াব নাহি”।