কলঙ্কিত হাথরাসে স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতি

সম্প্রতি এক নারকীয় ঘটনার জন্য সংবাদের শিরোনামে স্থান পেয়েছে উত্তরপ্রদেশের হাথরাস। যদিও ইতিহাসের পাতা ঘাটলে ছোট্ট এই শহরের গৌরবময় অতীত বেরিয়ে আসে। শতবর্ষেরও আগে এখানকার রেল স্টেশনে স্বামী বিবেকানন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর এক অন্তরঙ্গ শিষ্য তথা অনুগামীকে। চমকে ওঠার মতো নয় কি? স্বামীজির মতো মণীষী, যিনি ভারতের আধ্যাত্মিকতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সারা বিশ্বে, নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীশিক্ষার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন আজীবন, তিনি পা রেখেছিলেন হাসরাথে। আর সেখানেই কিছুদিন আগে গণধর্ষণ এবং নৃশংস অত্যাচারের ফলে মৃত্যুবরণ করলেন এক তরুণী।
১৮৮৭ সালের কথা, স্বামীজি তখন পরিব্রাজক হয়ে ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ঘুরছেন। বিভিন্ন তীর্থে যাচ্ছেন। জীবনধারণ করছেন ভিক্ষার মাধ্যমে। কখনও রাজা-মহারাজা কিংবা ধনী ব্যক্তিদের সাহায্য পেয়েছেন, কখনও বা থেকেছেন দরিদ্র মানুষদের সংস্পর্শে। কাশী এবং হরিদ্বার যাওয়ার পথে তিনি গিয়ে পৌঁছলেন হাথরাস স্টেশনে। সেখানে এক বেঞ্চে বসেছিলেন, তাঁকে দেখতে পেলেন হাথরাসের সহকারী স্টেশন মাস্টার শরৎচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর মনে হল, যুবক সন্ন্যাসীর করুণাময় উজ্জ্বল চোখে যেন অসীম জ্ঞানভাণ্ডারের চাবি লুকিয়ে আছে। নিজেই গিয়ে আলাপ করলেন। স্বামীজির তখন ২৫ বছর বয়স, আর শরতের ২৩। শরৎবাবু নিজে বাঙালি, জন্ম কলকাতার গড়পারে। তবে অল্প বয়সে উত্তর ভারত চলে যান। নিজের কর্মক্ষেত্রে বাঙালি সন্ন্যাসীর দেখা পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন। খাবারের বন্দোবস্ত করলেন তাঁর জন্য।
শরৎ গুপ্তই রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী সদানন্দ
স্বামীজির জ্ঞান এবং তেজস্বিতায় শরৎচন্দ্র এমনই প্রভাবিত হন যে সেই রাতে তাঁর অতিথি হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। স্বামীজি রাজি হলে তাঁকে নিয়ে যান স্টেশনের ঠিক পিছনে নিজের কোয়ার্টারে। দু’দিন সেখানে থাকলেন স্বামীজি। তাঁর গন্ধর্বনিন্দিত কণ্ঠের গান এবং উপদেশ শরৎচন্দ্রকে যেন উদ্ভাসিত করল। সহকারী স্টেশন মাস্টারের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে শরৎ চললেন স্বামীজীর সঙ্গে।
এই শরৎচন্দ্র গুপ্তই রামকৃষ্ণ মিশনের কর্মযোগী সন্ন্যাসী স্বামী সদানন্দ। সবার প্রিয় গুপ্ত মহারাজ। স্বামী বিবেকানন্দের অন্যতম প্রধান শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অদ্বৈত আশ্রম থেকে প্রকাশিত বই ‘The Life of Swami Vivekananda, by his Eastern and Western Disciples’ থেকে জানা যায়, শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করার আগে স্বামী বিবেকানন্দ শরৎচন্দ্রের আন্তরিকতা যাচাই করতে চেয়েছিলেন। শরতের হাতে নিজের ভিক্ষাপাত্র তুলে দিয়ে আদেশ করেছিলেন কুলিদের থেকে খাবার ভিক্ষা করতে। বিন্দুমাত্রা দ্বিধা না করে সেই আদেশ পালন করেন শরৎচন্দ্র। এতদিন যাঁরা ছিলেন তাঁর অধস্তন, তাঁদের থেকে ভিক্ষা চেয়ে স্বামীজিকে নিবেদন করেন। শরৎ তাঁর অহংবোধ বিসর্জন দিতে পেরেছেন দেখে খুশি হন স্বামী বিবেকানন্দ। ভিক্ষা করে পাওয়া সেই খাবার দু’জনেই তৃপ্তি করে খেলেন একসঙ্গে। তারপর দু’জনে ট্রেনে করে রওনা দিলেন হরিদ্বার।
আরও পড়ুন: শত্রুহীন এক কংগ্রেসি
পরবর্তীকালে স্বামী সদানন্দ দেশে-বিদেশে প্রচার করেছেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। কলকাতায় প্লেগ দেখা দিল ১৮৯৮ সালে। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্লেগসেবার কমিটি তৈরি হল, স্বামী সদানন্দ তার অফিসার ইন চিফ। তিনি কখনও বা ঝাড়ু হাতে শহরের আবর্জনা সাফ করছেন, কখনও বা প্লেগ রোগীর সেবায় দিনরাত জাগছেন, রোগী সুস্থ না হলে উঠছেন না। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অন্যান্য সন্ন্যাসীরাও মৃত্যুকে তুচ্ছ করে এগিয়ে গিয়েছিলেন প্লেগ নিরাময়ে।
স্বামী বিবেকানন্দ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের সঙ্গে স্বামী সদানন্দ
১৯১১ সালে কলকাতায় তাঁর মহাপ্রয়ান ঘটে। তাঁর এক বন্ধু নট কৃষ্ণও ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের অনুরাগী ও ভ্রমণসঙ্গী। একটি চিঠিতে নট কৃষ্ণ লিখেছেন, “এইভাবে আমরা এবং বাকিরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে আশীর্বাদময় দিনগুলি তাঁর সঙ্গে নিয়মিত আধ্যাত্মিক কথাবার্তার মধ্যে কাটিয়েছি। তাঁর পবিত্র সাহচর্যের শক্তিতে সাম্প্রদায়িক বিবাদ এবং বিদ্বেষ লোপ পেয়েছিল। যাঁরা বেশি বয়স কিংবা সমাজের উঁচু অংশে থাকার জন্য সম্মানিত হতেন, শিশুর মতো তাঁরা সেই তরুণ সন্ন্যাসীর পায়ের তলা বসে থাকতেন। সামাজিক অবস্থান এবং জ্ঞানের অহমিকা ত্যাগ করে ধর্মের নানা ব্যাপারে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। সন্ধেগুলি কাটত সংগীতের মধ্যে। স্বামীজী অসাধারণ সুন্দর কণ্ঠস্বরে উপস্থিত সবাই মোহিত হতেন এবং বাকরুদ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। যতই শুনতেন, ততই বেড়ে যেত শোনার খিদে”।
যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে শরৎচন্দ্র গুপ্ত তথা স্বামী সদানন্দের আধ্যাত্মিক গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল হাথরাসে। সর্বদাই নারী-পুরুষের সাম্যের পক্ষে উপদেশ দিতেন স্বামী বিবেকানন্দ। আর সেই হাথরাসেই জাতিভেদ এবং নারীর প্রতি অমানবিক হিংসার ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। নিয়তির পরিহাস একেই বলে!