চুঁচুড়ার কবরে ‘সাত খুন মাফ’-এর রহস্য

চন্দননগর থেকে চুঁচুড়া যাওয়ার পথে তালডাঙায় জি টি রোডের ঠিক ডান দিকেই চোখে পড়বে সাদা রং-এর একটা বিশাল গম্বুজ। স্থানীয় মানুষ একে ডেকে থাকেন বেশ কয়েকটা নামে। যেমন, ‘সাত বিবির কবর’, ‘মেমসাহেবের কবর’ কিংবা ‘সাত সাহেবের বিবির গোর’। এই কবরে যিনি শায়িত, তিনি একজন ওলন্দাজ মহিলা, নাম সুজানা অ্যানা মারিয়া ভারকার্ক। চুঁচুড়া-চন্দননগর অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করেন, সুজানা অ্যানার স্বামী ছিলেন সাত জন। অনেকে আবার এটাও মনে করেন, রাস্কিন বন্ড তাঁর চার পাতার ছোটোগল্প ‘Susanna's Seven Husbands’ লিখেছিলেন এই সুজানা অ্যানার জীবনকাহিনিকেই ভিত্তি করে। প্রসঙ্গত বলা যায়, গল্পটিতে মূল চরিত্রের নাম ছিল সুজানা অ্যানা মারি জোহানস। পরবর্তীকালে বিশাল ভরদ্বাজ ২০১১ সালে ‘সাত খুন মাফ’ ছবিটি তৈরি করেন সেই গল্প থেকে। সিনেমায় সুজানা অ্যানার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রিয়াংকা চোপড়া। বিশাল ভরদ্বাজ অবশ্য রাস্কিন বন্ডকে অনুরোধ করেছিলেন গল্পটাকে বড়ো করে আরেকবার লেখার জন্য, এবং বন্ডও সেটাকে বাড়িয়ে ৮০ পাতার একটি ছোটো উপন্যাস লিখে দেন। সেটা থেকেই বিশাল ভরদ্বাজ এবং ম্যাথিউ রবিন্স তৈরি করেছিলেন ওই সিনেমার চিত্রনাট্য। ‘সাত খুন মাফ’ ছবি দেখে যাদের ভালো লেগেছে, তারা একবার সময় করে ‘সাত সাহেবের বিবির কবর’ দেখে আসতেই পারেন।
যদিও ইতিহাসের নথিতে সুজানার মাত্র দুজন স্বামীর নামই পাওয়া যায়। বাকি পাঁচ জন স্বামী কে ছিলেন, আদৌ ছিলেন কিনা, কীভাবে তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল, তা এখনও রহস্য। প্রথমে সুজানার কথাই বলা যাক। তাঁর জন্ম হয়েছিল নেদারল্যান্ডের তিয়েল শহরে ১৭৪৩ সালের ৫ অক্টোবর। প্রথমবার তাঁর বিয়ে হয়েছিল ডাচ ব্যবসায়ী পিটার ব্রুইসের সঙ্গে, ১৭৫৯ সালের ১৬ অক্টোবর। পিটার ছিলেন একজন কর্মঠ মানুষ। ১৭৬৪ সালে তিনি কাশিমবাজারের ডাচ কুঠির দ্বিতীয় প্রধানের দায়িত্ব পান। প্রশাসনিক কাজে তিনি নিজের যোগ্যতা এবং দক্ষতা প্রমাণ করেছিলেন, যার ফলে তাঁকে নিযুক্ত করা হয় চুঁচুড়ার ডাচ কুঠির চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের পদে। পিটারের মৃত্যু হয় চুঁচুড়াতেই, ১৭৮৩ সালে। সুজানা এবং পিটারের তিন সন্তান ছিল – সুজানা জ্যাকোবা এবং মারিয়া অ্যানা দে ব্রুইস নামের দুই মেয়ে আর লুই আদ্রিয়ান দে ব্রুইস নামের এক ছেলে। পিটার ব্রুইসের সমাধি রয়েছে চুঁচুড়ার ফুলপুকুর রোডে ডাচ কবরখানায়। এদিকে তখন বাংলায় চলছে ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা, কখনও কখনও সেটা যুদ্ধের আকার নিচ্ছে। আস্তে আস্তে ব্রিটিশদের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে, আর পায়ের মাটি সরছে ডাচদের। চুঁচুড়াতেও আনাগোনা বাড়ছে ইংরেজদের। ১৭৯৫ সালে ৩০ মার্চ সুজানা অ্যানা বিয়ে করলেন একজন ধনী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীকে। নাম থমাস ইয়েটস। এই বিয়ের পর সুজানার নাম হয় সুজানা অ্যানা মারিয়া ইয়েটস।
১৮০৫ সালে সুজানা একটি উইল করেন। ছেলে লুইকে তিনি দেন ৬টি ঘোড়া, একটি ঘোড়ার গাড়ি এবং একটি বাড়ি। একটা ট্রাস্ট তৈরি করেন নিজের এবং দুই স্বামীর কবর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। সুজানার মৃত্যু হয় ১৮০৯ সালের ১২ মে। তালডাঙায় ‘আয়েশবাগ’ নামে তাঁর একটা বড়ো বাগানবাড়ি ছিল, সুজানার ইচ্ছে অনুযায়ী সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সুজানার কবরটি ইন্দো-ওলন্দাজ স্থাপত্যের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। কবরের ওপর রয়েছে ১৫ ফুট উঁচু একটি আটকোণা সৌধ। দোতলা সৌধের চারদিকে খিলান লাগানো দরজা আর ওপরে গম্বুজ বসানো রয়েছে। অনেকে মনে করেন, কাশিমবাজারের একটি ডাচ কবরের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে সুজানা অ্যানার সমাধি।
তথ্যসূত্র – Hooghly Heritage, Wanderlust, Tripoto