ঘাড় ঘোড়াতেই দেখি পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির ‘রাজপুত্র’

চোখের সামনে মারাদোনার প্র্যাকটিস। কখনও নিজের তালে কাটাচ্ছেন, পায়ে বল নাচাচ্ছেন, কখনও ডেড বল প্র্যাকটিস করছেন। আর্জেন্টিনার ক্যাম্পে তখন আমরা সবাই হাঁ করে দেখছি সেইসব। এই ক্লিপিংস রাতে দেখবে ভারতের আপামর দর্শক। পর্দার এপার থেকে। আর আমরা যাঁরা এর শুটিং-এর দায়িত্বে, তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছি না আমাদের সামনেই হেঁটে-চলে-ঘুরে বেড়াচ্ছেন ফুটবলের ‘ঈশ্বর’ দিয়েগো মারাদোনা।
আরও পড়ুন: ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ হতে পারত অনেক আগেই
এমন সুযোগ কীভাবে পেলাম, তা বোঝাতে গোড়াতেই ফিফার অ্যাক্রেডিটেশনের নিয়ম নিয়ে দু-চারকথা বলে নেওয়া ভালো। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের কিছু নামকরা টেলিভিশন চ্যানেল বা ভারতের বিভিন্ন চ্যানেলে দেখি, উপস্থাপকরা মস্কো কিংবা মস্কোর আশেপাশের রাস্তাঘাটে ঘুরতে ঘুরতে বলছেন, বিশ্বকাপের খুঁটিনাটি দর্শকদের দেখাতে তাঁরা সুদূর রাশিয়ায় হাজির হয়েছেন। কোনো উপস্থাপক বা তাঁর চ্যানেলকে কটাক্ষ করে বলছি না, কিন্তু এটা নেহাতই একটা দেশে বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে ‘রাশিয়া থেকে বলছি’ গোছের কিছু ধারাভাষ্য। এর সঙ্গে মূল খেলার এবং খেলা-সংক্রান্ত কোনো জায়গার, যেমন – ট্রেনিং ফিল্ড, ড্রেসিং রুম, খেলোয়াড়দের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ - এসব কোনোকিছুরই যোগাযোগ নেই। তবে বর্তমানে ফিফার নিয়ম এমনই। ফিফাই সিদ্ধান্ত নেয় কাকে কোথায় কতটা প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। এবং এই অনুমতির ‘মূল্য’ বিশাল অঙ্কের টাকা। তাই সাধারণত ভারতীয় কোনো টেলিভিশন মাধ্যম সেখানে ঢুকতে পারে না।
গায়কোচিয়া
আমাদের বেলায় যে-কোনো কারণেই হোক, ফিফার এই নিয়ম-কানুন অনেক শিথিল ছিল। তাই আমরা অবলীলায় একেকটা দেশের ট্রেনিং সেন্টার, ড্রেসিংরুমে ঢুকে পড়তাম। খেলোয়াড়দের সঙ্গে আড্ডাও মারতাম। বিশ্বকাপে গিয়ে এই পরিমাণ স্বাধীনতা পাওয়া ছিল আমাদের প্রত্যেকের সাংবাদিক-জীবনের একটা বড়ো প্রাপ্তি। আমরাও চেটে-পুটে চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার করেছি সেই সুযোগের। তাই আজ টেলিভিশনের সামনে বসে যখন দেখি ‘রাশিয়া থেকে এক্সক্লুসিভ বিশ্বকাপ কভারেজ করছি’, তখন আবার সেই আটাশ বছর আগেকার মুহূর্তগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আরও পড়ুন: ভারতীয় টেলিভিশনে প্রথমবার বিশ্বকাপ-যুদ্ধ
সকাল ন’টায় হোটেল থেকে বেরিয়ে মিডিয়া সেন্টার। আমাদের অভিজিতের কাঁধে প্রায় ছ-সাড়ে ছয় কেজির ভিডিও রেকর্ডার, আর ঘাড়ে প্রায় দু-তিন কেজির বিশাল আকারের লো-ব্যান্ড ক্যামেরা, শুভাশিসের হাতে সাউন্ড বুম, আর বাকিরা আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে। মারাদোনার ট্রেনিং দেখতে যাওয়ার ও রেকর্ড করার উত্তেজনায় ফুটছি আমরা। মিডিয়া সেন্টার থেকে বাসে করে ২৫ কিমি দূরে ট্রিগোনিয়া নামের ছোট্ট একটা শহরে আর্জেন্টিনার টিম ক্যাম্প করেছিল। সারাটা রাস্তা জুড়েই ইতালি, আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা। মাঝেমধ্যে রাস্তার এপাশ-ওপাশে জটলা করে বিভিন্ন দেশের সমর্থকরা নিজেদের মধ্যে গানবাজনা করছে, হৈ-হল্লা করেছে। গোটা দেশ বিশ্বকাপের নেশায় বুঁদ।
বুরুচাগা
পৌঁছোতে সময় লাগল আধঘণ্টা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, মূলত মারাদোনা ছিল বলেই হয়তো। তবে আমাদের অ্যাক্রিডিটেশনের মধ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল বলে বিশেষ হ্যাপা পোহাতে হয়নি সে যাত্রায়। আমরাও জীবনে এই প্রথম কোনো দেশের ট্রেনিং ক্যাম্পে ঢোকার মধ্যে যে উত্তেজনা, সেটা ভেতরে রেখেই অনেকটা প্রফেশনাল অঙ্গভঙ্গি করে ক্যাম্পে ঢুকে পড়লাম। ঢুকেই দেখি ট্রেনারের সামনে স্ট্রেচিং করছেন বাতিস্তা ও বুরুচাগা। ক্যানেজিয়া শট নিচ্ছেন আর গোলপোস্টের তলায় গায়কোচিয়া। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সহকারী কোচ ও আরও দুজনের সঙ্গে কথা বলছেন বিলার্দো। আর্জেন্টিনার প্রধান কোচ। এসব দেখে তো আমাদের উত্তেজনার শেষ নেই। অভিজিৎ ক্যামেরা নিয়ে ছোটাছুটি করছে। আর আমার ভয় লাগছে, এই বুঝি কেউ বারণ করল কোথাও যেতে। অপমানের ভয়। কিন্তু, শেষ অবধি তেমন কিছুই হল না।
আর্জেন্টিনার ট্রেনিং ক্যাম্প
হঠাৎ ঘাড় ঘোড়াতেই দেখি পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির রাজপুত্র। দিয়েগো মারাদোনা। হাতে দুটো বল নিয়ে ট্রেনিং সেন্টারের ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে ঢুকলেন। আমাদের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। প্রথমেই এসে একটা বল সজোরে আকাশের দিকে কিক করলেন মারাদোনা। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে কী রাজকীয় এন্ট্রি! বলটা তিরিশ-চল্লিশ ফিট উপর থেকে যখন নামছে, কী হেলায় বাঁ পায়ের চেটো দিয়ে রিসিভ করে নিলেন মারাদোনা। আমার মনে হল, ফুটবলের রাজপুত্রের পায়ে ফিরেই যেন নিশ্চিন্ত হল বলটা, মালিকের কাছে আশ্রয় পেল। আর তারপর, পনেরো মিনিট ধরে স্রেফ একা বল নিয়ে প্র্যাকটিস। চৌখুপি সেলাই করা একটা বলের ওপরে মারাদোনার আধিপত্য যে কী হতে পারে, তা নিছক শব্দে লিখে বোঝানো অসম্ভব। বিলার্দোর সঙ্গে কথা বলে মনে হল, মিলানে ক্যামেরুনের মতো তুলনায় দুর্বল টিমের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ হলেও, ম্যাচটাকে মারাদোনা যথেষ্ট সিরিয়াসলি নিচ্ছেন। প্লেয়ারদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও বোঝা যাচ্ছিল, ট্রেনিং সেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ এঁদের কাছে।
মারাদোনা
মারাদোনা মাঠে ছিলেন ঠিক পঁচিশ মিনিট। টিমমেটদের সঙ্গে ড্রিবল করলেন খানিক, মিনিট সাত-আটেক ধরে ডেড বল প্র্যাকটিস। তারপর চলে গেলেন। দেড়ঘণ্টা ধরে প্র্যাকটিসের কোনো বালাই নেই। স্টারের মেজাজ বলে কথা! এই ট্রেনিং সেশনের শেষেই আলাপ হল পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা অমিয় তরফদারের সঙ্গে। অনেকের মনে আছে হয়তো, এই অমিয় তরফদারই ’৮৬-তে মারাদোনাকে নামাবলি পরিয়েছিলেন ট্রেনিং সেশনে। সেই ছবি বড়ো বড়ো করে বেরিয়েওছিল বিভিন্ন কাগজে। উনি ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার।
মিলান শহরের সান সিরো স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ-আর্জেন্টিনা বনাম ক্যামেরুন। আগেই বলেছিলাম, ক্যামেরুনকে নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস ছিলেন গতবার চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা দলের ম্যানেজার থেকে শুরু করে খেলোয়াড়রা সবাই। ম্যাচের আগে ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে অন্তত তেমনই ধারণা হয়েছিল আমার। ক্যামেরুনের আটত্রিশ বছরের রজার মিল্লা-র খেলা আগেই দেখেছিলাম। যাঁকে ফুটবল জগৎ ‘বল আর্টিস্ট’ বলে ডাকত। ক্যামেরুনও যে হাল ছাড়বে না, তা তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। বিশ্বকাপও যেন অপেক্ষা করে ছিল একটা টানটান ম্যাচের, যা শুরু থেকেই গোটা টুর্নামেন্টের টোন সেট করে দেবে।
বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। হার-জিত, হাসি-কান্নার মেলা চারদিকে। এরই মধ্যে আমাদের নাপোলি যাত্রা। নাপোলির মাঠে আর্জেন্টিনা-ইতালির হাই টেনশন সেমিফাইনাল ম্যাচ। ওই ম্যাচ ঘিরে ইতালির সমর্থকদের দ্বিধা ছিল চোখে পড়ার মতো। তখন মারাদোনা ক্লাব ফুটবল খেলেন নাপোলিতে। তিনি ওখানকার সমর্থকদের কাছে প্রায় ঈশ্বর। তাঁর উন্মাদ ভক্ত ও দেশে কম নেই। আবার, খোদ ইতালির মাটিতে ইতালিই খেলছে সেমিফাইনাল। এমনই এক পরিস্থিতিতে আমরা সারারাত জার্নি করে রোম থেকে গেলাম নাপোলিতে, ম্যাচ কভার করতে। ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড়। আমাদের দলের সদস্য দেবকান্ত আর মোহান্তি সেই ট্রেনের বাথরুমের সামনে মেঝেতে বসে-বসে রাত কাটিয়েছিল। যেমনটা প্রায়ই ঘটে থাকে আমাদের দেশের দূরপাল্লার ট্রেনে। যাইহোক, নাপোলির সেই ম্যাচ পেনাল্টি শ্যুট আউটে জেতে আর্জেন্টিনা। তারপর, এই হার নিয়ে ক্ষুব্ধ দর্শকরা হাঙ্গামাও পাকিয়েছিল নাপোলিতে। আর সেই ঝামেলার মধ্যে ফেঁসে গিয়েছিলাম আমরাও।
আমাদের ট্রেন যাত্রা
গতকাল ফুটবলের ঈশ্বর মারাদোনা চলে গেলেন। চোখের সামনে দেখা একের পর এক হাই টেনশন ম্যাচ দেখার যে লোভনীয় অভিজ্ঞতা আমার বা আমাদের হয়েছিল, তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে হয় অবশ্যই। তাঁকে স্বচক্ষে দেখেছিলাম বলেই মারাদোনার মৃত্যুসংবাদ আমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল ত্রিশ বছর আগের সেইসব মাঠে। যে মাঠ থেকে ফিরতে মন চায় না। অথবা যে মাঠ থেকে এখনও ফিরিনি আমি।