No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ইংল্যান্ডে বাঘ-সিংহের খেলা দেখাতেন, ব্রাজিলের রাষ্ট্রবিপ্লবে যুদ্ধও করেছিলেন সুরেশ বিশ্বাস

    ইংল্যান্ডে বাঘ-সিংহের খেলা দেখাতেন, ব্রাজিলের রাষ্ট্রবিপ্লবে যুদ্ধও করেছিলেন সুরেশ বিশ্বাস

    Story image

    “অন্নপায়ী বঙ্গবাসী, স্তন্যপায়ী জীব/ জন-দশেকে জটলা করি তক্তপোষে ব’সে।”

    বাঙালির জীবনে অ্যাডভেঞ্চার নেই। ঢিমেতালে দিন গুজরান। বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দীতে, পূর্বপুরুষের জমিদারি ভাঙিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বৈঠকখানা গরম করাই ছিল দস্তুর। উপার্জন বলতে, ‘সাহেবী আপিসে’ পান মুখে কলম পেষা। কালাপানি পার হতেন অবশ্য কেউ কেউ। তারপর ফিরে আসতেন ইংরেজ মনিবের কাছ থেকে মোটা মাইনের চাকরি নিয়ে। 

    ১৮৮১-১৮৮২ সালে ‘রয়াল এগ্রিকালচারাল ওয়ার্ল্ড ফেয়ার’-এর একটি পোস্টার বেরিয়েছিল। সেই পোস্টারের উপর দিকে ডান কোণের ছবিটি লক্ষণীয়। বাঘ-সিংহের খাঁচায় জমকালো পোশাকে দাঁড়িয়ে এক যুবা। মাথায় পাগড়ি। বলাই বাহুল্য, যুবকটি ভারতীয়। এবং বাঙালি! নাম, সুরেশ বিশ্বাস।  

    কোন সুরেশ বিশ্বাস? যিনি সিংহের খাঁচায় অনায়াসে ঢুকে পড়েন? যাঁর একটি ধমকে হিংস্র বাঘ বেড়ালছানার মতো গুটিশুটি মেরে যায়? কোন সুরেশ বিশ্বাস? যিনি পঞ্চাশজন সৈন্য নিয়ে ব্রাজিলের নিথেরয় বন্দর রক্ষা করেছিলেন? রেঙ্গুনে গুন্ডার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে ফিরেছিলেন যিনি? নাকি, ব্রিটিশদের বেমালুম বোকা বানিয়ে নকল ভারতীয় ‘শিল্পদ্রব্য’ বেচে বেশ দু’পয়সা হয়েছিল যাঁর?

    সুরেশের জীবনটা রোমাঞ্চ-উপন্যাসের মতো। পাকে পাকে জড়িয়ে অজস্র মিথ। পড়লে মনে হয় অবিশ্বাস্য। 

    ছেলেবেলা থেকে ডানপিটে। শোনা যায়, গাছে উঠে পাখির ছানা পাড়তে গিয়ে হাত পড়েছিল গোখরোর ল্যাজে। পকেট থেকে ছুরি বের করে ফালাফালা করে ফেলেছিলেন বিষধর ফণা। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বছর ষোলো-সতেরোর সুরেশ বেরিয়ে পড়েছিলেন চাকরির খোঁজে। তার আগে, কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিখে ফেলেছেন স্কুলে থাকাকালীনই। কিন্তু মিশনারি স্কুলের ঘড়িধরা রুটিনে বাঁধতে পারেননি নিজেকে। বন্দরে বন্দরে ঘুরেছেন। রেঙ্গুন থেকে চেন্নাই, চাকরি দেয়নি কেউ। তবুও, কুড়িয়ে বাড়িয়ে কখনো টুরিস্ট গাইড, আবার কখনো বা ফিরিঙ্গি সাহেবের কেয়ারটেকার... শেষে এক ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের স্টুয়ার্ড হয়ে পাড়ি দিচ্ছেন ইংল্যান্ড। সেখানে পয়সা উপার্জনের নানা ফন্দিফিকির খুঁজছেন তিনি। হাতে কাঁচা টাকা এলেই অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন অবলীলায়। সুপুরুষ চেহারার এই ভারতীয়টি নিষিদ্ধপল্লীতেও জনপ্রিয়। তবে গণিকারা তাঁকে ভালোবাসলেও, নিজে কোনোদিন সেই ভালোবাসায় ধরা দেননি সুরেশ। 

    একবার ইংল্যান্ডের কেন্টে ঘুরতে ঘুরতে সুরেশ ঢুকে পড়লেন এক সার্কাসের তাঁবুতে। ব্যবসায় মন্দা চলছে তখন। সেই সার্কাসের সব থেকে বলশালী লোকটাকে ক’মিনিটে চিৎপাত করে দিতেই চাকরি পাকা হয়ে যায় তাঁর। ট্রাপিজ, এক্রোব্যাটিক্স থেকে বাঘ সিংহের খেলা। সারা ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়ছে খ্যাতি। অকুতোভয়ের সমার্থক হয়ে উঠছেন সুরেশ বিশ্বাস। এর মধ্যে তাঁর আলাপ হয়েছিল বিখ্যাত জার্মান পশু-প্রশিক্ষক গাজেনবাখের সঙ্গে। সার্কাস ছেড়ে ক’দিন পশুশালার দায়িত্বও সামলেছেন রিং মাস্টার...

    কয়েক বছর বাদেই অবশ্য সুরেশকে দেখা যাবে সৈনিকের পোশাকে। ব্রাজিলে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কারণ, তাঁর স্ত্রী মারিয়া অগাস্টা ফার্নান্দেজ। ফার্নান্দেজ বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর সাজে নাকি বড়ো ভালো দেখতে লাগে সুরেশকে। স্থানীয় এক চিকিৎসকের কন্যাকে দেখে প্রেমে পড়েছিলেন বছর পঁচিশের বাঙালি তরুণ। এ তাঁর প্রথম প্রেম না। তবে শেষ প্রেম অবশ্যই। ভালোবাসা পেয়ে লন্ডভন্ড করে চলে এসেছেন নিজের সার্কাস জীবন। পিছনে পড়ে রইল খ্যাতির রোশনাই। সুরেশ কর্পোরাল থেকে হয়ে উঠছেন সার্জেন্ট। শিখছেন  বন্দুক চালানো, অস্ত্রোপচারের খুঁটিনাটি। 

    ইংল্যান্ডে থাকতে থাকতেই নিজেকে নানা বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছেন। ইস্কুল পালানো মানুষটা শিখে ফেলেছিলেন বেশ কয়েকটি ভাষাও। রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, ইতিহাসে অগাধ জ্ঞান। ভূতপূর্ব বাঙালি রিং-মাস্টার ‘রিও’তে থাকাকালীন বিভিন্ন পার্কে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন। ব্রাজিলের সম্ভ্রান্ত মহলে তাঁর অবাধ যাতায়াত। চামড়ার রং-এর জন্য প্রথমে ঝক্কি পোহাতে হলেও খুব দ্রুত সেনাবাহিনীতেও উন্নতি করেন সুরেশ।

    ১৮৯৩ সালে ব্রাজিলে শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রবিপ্লব। বিদ্রোহী নৌবাহিনীর, গোলাবর্ষণের মাঝে সুরেশরা রক্ষা করছিলেন দুর্গ। আক্রান্ত হল রিও ডি জেনেইরোর শহরতলি নিথেরয়। কামানের গোলায় বিধ্বস্ত বন্দরে শক্ৰসৈন্য নামল, শহরের দখল নিতে। আর ঠিক তখনই ধ্বংসস্তূপের মাঝে ঝিকিমিকি করে ওঠে পঞ্চাশটি তরবারি। ভয়ানক লড়াই-এর পর পিছু হটেছিল শত্রুসৈন্য। সেই পঞ্চাশজন বীরের মধ্যে যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা ভোলেননি তাঁদের অসমসাহসী ভিনদেশি নায়কটির কথা।

    মাত্র ৪৫ বছরের সুরেশ মারা যাচ্ছেন ব্রাজিলেই। আনুমানিক ১৯০৫ সালে। তাঁর কীর্তিকলাপের বৃত্তান্ত ধীরে ধীরে পৌঁছয় ভারতে, ক্রমে বাংলায়। অলস, উচ্চাশাহীন বাঙালীকে অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সুরেশ। তাঁর হাত ধরেই বাংলার যুবসমাজ আরব বেদুইনের মতো বেরিয়ে পড়ছিল দেশ-দেশান্তরে। বাংলার শ্রেষ্ঠ এডভেঞ্চার উপন্যাসের নায়ক, শংকরের অন্যতম অনুপ্রেরণা যে ছিলেন সুরেশ বিশ্বাস, তা বলাই  বাহুল্য। 

    ঋণ : Lieut. Suresh Biswas: His life and Adventures -  H Dutt. (Jadavpur University Press), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    চিত্রঋন : Lieut. Suresh Biswas: His life and Adventures -  H Dutt.

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @