হ্যালুশিনেশন, উদ্যত খাদ, জ্ঞান হারানো-- তবু একদৌড়ে ৯৯ কিমি

ধূসর মরু হিমালয়ের মাঝে নুব্রা নদীর তীরে সবুজ একটি গ্রাম সুমুর। উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নয়, সিয়াচেন আসা যাওয়ার পথে গ্রামটি খুঁজে পেতে হলে ম্যাপ ধরে অনেকটা জুম ইন করতে হয়। সেই ছোট্ট গ্রামটিতে সেদিন যেন চাদের হাট বসেছিল।
আমরা ছিলাম তিরিথ ক্যাম্পের আপেলবাগানে। সেখান থেকে বিকেল ৫টায় নিয়ে যাওয়া হল সুমুর গ্রামটিতে। দেশ-বিদেশের নানা রানার, আর্মি, মিডিয়া মিলিয়ে ছোট্ট গ্রামটি তখন গমগম করছে। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে তোরণ খাটানো হয়েছে, স্থানীয় রীতিতে প্রার্থনা চলছে, রীতিমতো উৎসবের আমেজ। তারই মাঝে সবাই অবাক চোখে দেখছে, এরা দৌড়ে দৌড়ে লেহ যাবে!
আরও পড়ুন
নুব্রা থেকে একদৌড়ে লে—মাত্র ১১১ কিমি
ঠিক সন্ধে ৬টায় দৌড় শুরু হল। আমি প্রথম থেকেই রক্ষণাত্মক খেলছিলাম। হাঁটুতে চোট নিয়ে তার আগে একমাস দৌড়াইনি। সর্বাধিক ৭৪ কিমি অবধি দৌড়েছি আগে। এটা ১১১ কিমি, তাও ৫০০০ মিটারের উপরে! তার উপর, সারারাত দৌড়েরও অভিজ্ঞতা নেই। সব কিছু মিলিয়ে আমার টার্গেট ছিল কাট অফ টাইমের মধ্যে দূরত্বগুলো অতিক্রম করতে করতে যাওয়া।
সুমুর থেকে খালসার-- প্রথম ২১ কিমি সামান্য চড়াই-উতরাই। খুব সহজেই সকলে দৌড়তে দৌড়তে পেরিয়ে গেল। বিশাল নুব্রা ভ্যালিতে তখন সূর্যাস্ত হচ্ছে, ধীরে ধীরে অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়ছে গোটা উপত্যকা। অদ্ভুত সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে দৌড়াচ্ছি। খালসার পেরিয়ে যখন চড়াই শুরু হল তখন পুরো অন্ধকার, মাথায় টর্চ বেঁধে পেছনের ব্যাগে ব্যাকলাইট ঝুলিয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে যখন চড়াই আরো বাড়ছে খানিক দৌড়চ্ছি, খানিক হাঁটছি। ততক্ষণে চাঁদ উঠেছে, নুব্রার উপনদী শিয়ক দেখা যাচ্ছে অনেক নিচে। পুরো ভ্যালি তখন রুপোলি আলোতে ঝকমক করছে। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগল, সঙ্গে ক্লান্তিও। প্রায় ৪৪ কিমি পেরিয়ে যখন খার্দুং গ্রামে পৌঁছলাম, তখন রাত সাড়ে ১২টা। কোত্থাও কেউ জেগে নেই, কোনো মানুষ-জন্তু-জানোয়ার কিচ্ছু নেই। শুধু কয়েকজন রানার পাহাড়ের গা বেয়ে দৌড়ে চলেছে। ৬১ কিমি পেরিয়ে যখন নর্থ পুল্লু পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় চার ছুঁই ছুঁই।
এবারে বুঝলাম সত্যিকারের ক্লান্তি আমায় ঘিরে ধরেছে। একটু ঘুমোলে ভালো হত, কিন্তু ঘুমনোর সময় নেই। অল্প একটু ম্যাগি সুপ খেয়েই রওনা দিলাম খার্দুংলার দিকে। ততক্ষণে আমি প্রায় ১৪,০০০ ফুটেরও ওপরে, আমার পেছনে দু-তিনজন রানার সময়ের মধ্যে পৌঁছতে পারেনি বলে ডিসকোয়ালিফাই হয়ে গেছে। একজনকে দেখলাম উপর থেকে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নর্থ পুল্লু ফিরে আসতে। আমি একা এগিয়ে চলেছি প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে। বুঝলাম একটু গরম কিছু খেতে হবে। ধীরে ধীরে ঘুমে যেন চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। একটু দূরে মনে হল খাবারের ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম, ওমা! কিছুই নেই! আবার এগোতে লাগলাম ঘোরের মধ্যে, মনে হল টলছি। হঠাৎ হুঁশ ফিরতেই দেখি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। বুঝলাম, হ্যালুসিনেসনে আছি আমি। টানা ১০ ঘন্টা, অন্ধকারে ৬৫ কিমি দৌড়, ১৫০০০ ফুটের ওপরে অক্সিজেনের অভাব, ভোর-রাতের চরম ক্লান্তিতে আমার মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। আশেপাশে কেউ নেই সাহায্য করার মত। ওয়াকিং স্টিকের উপরেই মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিংবা হয়তো অজ্ঞানই হয়ে গেছিলাম। হঠাৎ গাড়ির হর্নে ঘুম ভাঙল। ততক্ষণে ৫টা পেরিয়ে গিয়েছে, সবাই চলে গিয়েছে। রেস ডিরেক্টর সব গুছিয়ে সবার শেষে আসছে। আমায় বলল, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, ৮টার মধ্যে খার্দুংলা পৌঁছাতে পারবেনা।
ক্লান্তি কাটিয়ে চোখ মিলে তাকালাম। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটছে, সামনে গাড়ির দরজা খোলা। খার্দুংলা তখনও বহুদূর। মনে হল, অনেক হয়েছে, এবার গাড়িতে বসি, এগিয়ে গেলাম। কিন্তু, গাড়ির দরজায় হাত রেখে ভাবলাম-- যে দৌড়ের কথা এতদিন স্বপ্নে ভেবেছি, যার জন্য দিনের পর দিন এত আত্মত্যাগ, এতকিছু ম্যানেজ করা আসা, এত সহজে ছেড়ে দেব? এখনও তো তাকাতে পারছি, শ্বাস চলছে। এখনও আড়াই ঘন্টা আছে আমার হাতে। আর, হাই অল্টিচিউডেই তো সব থেকে বেশি কমফর্টেবল আমি। বাইরে থেকেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে বললাম, আমি পারব।
রেস ডিরেক্টর একটু বিরক্তই হল। আবার অপেক্ষা করতে হবে ৮টা অবধি, খাবারের ভ্যানও সব চলে গেছে। আমার কাছে একটা ক্যাডবেরি আর ২৫০মিলি জল পড়েছিল, তাই নিয়েই জোরে জোরে হাঁটা শুরু করলাম। ওই উচ্চতায় দৌড়নো সম্ভব ছিল না। নিজের গতিকেই তখন বিশ্বাস করতে পারছি না। মাত্র আড়াই ঘন্টায় ঠিক ৭টা ৫৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম খার্দুংলা। পৌঁছেই উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলাম-- আমি একজন পর্বতারোহী, আমি হাই অলটিচিউডে খেলাধুলো করি! সকলেই সেদিন হাততালি দিয়ে আমায় স্বাগত জানিয়েছিল।
অল্প একটু সুপ খেয়ে ফের নেমে গেলাম নিচের দিকে, সাউথ পুল্লু পৌছলাম ১১টার দিকে। আর তিনঘন্টায় ২৮ কিমি পেরোতে হত। যেটা কোলকাতায় প্রায়ই প্র্যাকটিস করে থাকি। জুতো,মোজা পালটে এবার দৌড়নো শুরু করলাম। প্রথম ১০ কিমি পেরনোর পরে পায়ের হাড়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হল। এবার বুঝলাম-- অনভিজ্ঞতার ফল, আমার পা নিতে পারছে না আর। বাধ্য হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। শেষ যখন ১২ কিমি বাকি, তখন হাতে আর সময় মাত্র ১ ঘন্টা। এবারে আমায় সিদ্ধান্ত নিতে হত। ডাক্তার আমায় ছুটতে না করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ৯৯ কিমি পেরিয়ে খার্দুংলা টপকে এসেছি। দেড় ঘন্টার মধ্যে আর ১২ কিমিও শেষ করে দেব, কিন্তু পায়ে বড়সড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সবে দেড় বছর হল দৌড়নো শুরু করেছি, এর মধ্যে লা আল্ট্রাতেও নামতে পেরেছি। আমাকে আরো সময় নিয়ে আরো ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, অভিজ্ঞতা জড়ো করতে হবে, ফের ফিরে আসব এই ট্র্যাকে, পরে কখনো। সবটা ভেবে, আমি ইতি টানলাম ঠিক সেই ৯৯ কিমি মার্কে। ১০০ কিমি পের হব পরে কখনো, নিজের মত করে।
জুল্লে!