যৌনকর্মী থেকে সফল রুপান্তরকামী হয়ে ওঠার লড়াই
![Story image](https://www.bongodorshon.com/uploads/story_image/sumi_das.jpg)
কোচবিহার নিবাসী অরিন্দম দাস, সুমি হিসেবেই পরিচিত। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে প্রান্তিক লিঙ্গ এবং দলিত রূপান্তরকামী মানুষের অধিকার এবং জীবিকা নিয়ে কাজ করছেন। এই মুহূর্তে মৈত্রী সংযোগ সোসাইটি নামক একটি এনজিও’র প্রধান দায়িত্বে রয়েছেন। স্টেশনে রাত কাটানো, যৌন পেশায় যুক্ত হওয়া থেকে এনজিও তৈরি করা- তাঁর এই যাত্রাপথের কথা শুনলেন সুমন সাধু।
• সুপ্রিম কোর্টের ৩৭৭ ধারা নিয়ে একটি ঐতিহাসিক রায়, আমাদের তথাকথিত সমাজে সত্যিই কতটা ‘পরিবর্তন’ এনে দিয়েছে?
প্রথমত ৩৭৭ ধারার ইতিহাসটা যদি দেখো, অন্তত আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এই ধারা নিয়ে কমিউনিটির মানুষ যে খুব একটা চিন্তিত বা অত্যাচারিত, এর নজির খুব একটা নেই। কিছু কিছু কেস হয়েছে, যেমন ব্যাঙ্গালোর বা দিল্লিতে। এবার তুমি যদি গ্রামের দিকে যাও তাহলে দেখবে, সেখানে ৩৭৭ ধারা নিয়ে কেউ জানেনই না। তাঁদের কাছে অনেকটা খায় না মাথায় দেয়, এই টাইপের। এটা যখন উঠে গেল, তখন মানুষের মনে হইচই শুরু হল, যে এমন একটা ধারা ছিল।
• যতদূর জানি আপনি কোচবিহারের একটি গ্রামে থাকেন। গ্রাম্য পরিবেশে বড়ো হয়ে নিজের সত্তাকে প্রকাশ্যে আনলেন কীভাবে?
আমার জন্ম হয় কোচবিহারের দিনহাটা নামক একটা গ্রামে। এমন একটা পরিবারে আমার জন্ম হয়, যেখানে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটাই অনেক বড়ো ব্যাপার। সেখানে বড়ো হয়ে উঠে নিজের সত্তাকে প্রকাশ করার কোনো জায়গা ছিল না। ১৪ বছর বয়সে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। তখন যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। প্রথম আশ্রয়স্থল হল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। স্টেশনেই বেশকিছু রাত কাটাই। খাবারের জন্য আমাকে যৌনকর্মীর পেশা বেছে নিতে হয়েছিল। তারপরেই আমি এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হই। গ্রামের আবহাওয়াটাকে অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। বাইরের কারোর সঙ্গে মেশার কোনো সুযোগ ছিল না। আর মেয়েলি হওয়ার জন্য স্কুল-কলেজে সমস্যা তো হয়েই থাকে। আমার চোখটা কিন্তু খুলেছিল শিলিগুড়ি শহরে। তাই গ্রামের পরিবেশ খুব একটা ম্যাটার করেনি।
• কিছুদিন আগে একটি টক-শো’তে আপনাকে দেখা গিয়েছিল। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় সেটি পোস্ট করে আপনি লিখেছিলেন, “যাত্রাই বটে। রং কালি মেখে যাত্রা করেই তো যাচ্ছি।” এই ‘ট্রান্স’ শব্দটা এলেই কি নিজেকে সবসময় সাজিয়ে-গুছিয়ে বাইরে বেরনোর প্রসঙ্গ আসে?
না না। আমি নিজেকে শুধুমাত্র ট্রান্সজেন্ডারের খোপে আটকে রাখি না। এই যে মেয়েদের মতো হয়ে উঠতে হবে, সেটা কিন্তু নয়। আর যারা নিজেদের সাজিয়ে তুলছে, কোথাও গিয়ে নিজেদের মেয়ে ভাবছে বা অনেকে ভাবছেও না। এই পুরো বিষয়টাই তো একটা যাত্রাপথ।
• হ্যাঁ তাই তো। বহিরঙ্গের সাজটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভিতরে ভিতরেও যে একটা সাজ তৈরি হচ্ছে সেটাই মুখ্য আসলে।
ঠিক। একদমই তাই।
• তৃতীয় লিঙ্গ মানুষ মানেই কি ‘প্রান্তিক’? আর তৃতীয় লিঙ্গই বা কেন? তাহলে প্রথম লিঙ্গ, দ্বিতীয় লিঙ্গ কারা? আপনার কী মনে হয়?
আমি লিঙ্গ বিভাজনে বিশ্বাসী নই। মানুষকে মানুষ হিসাবে বোঝার চেষ্টা করাই ভালো। একটা মেয়ের হাতে যখন ক্ষমতা এসে যায়, তখন সে ওই পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে। যারা টম বয়, তারা কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সেভাবে অত্যাচারিত হয় না। কিন্তু একটা ছেলে যখন নিজেকে মেয়ে ভাবছে, তাকে কোথাও কাজে নেওয়া হচ্ছে না। সমাজে তো মেয়েদের এখনও নিচু চোখে দেখা হয়। আর ‘মেয়েদের মতো’ হলে আরও নিচু। আমি তাই লিঙ্গ বিভাজনে বিশ্বাস করি না। আমার মতে মানুষ দুইরকম- ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ।
তৃতীয় লিঙ্গ মানেই প্রান্তিক নয়। অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এবার দেখতে হবে তাঁরা কোন শ্রেণি থেকে উঠে আসছেন। প্রত্যন্ত গ্রামের দলিত পরিবারের কোনো রূপান্তরকামী এখন সাংঘাতিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, এমন উদাহরণ খুব কমই আছে। আর্থিকভাবে সচ্ছল সবাই। এখানেও কিন্তু শ্রেণি বিভাজন, জাত-পাত এ সবকিছুই এসে যায়। যারা লুঙ্গি পরে থাকেন, তাঁরাও তো এলজিবিটি আন্দোলনের অংশ। কিন্তু তাঁদের কথা তুমি তেমন শুনতে পাবে না। এখানেও সেই পুঁথিগত শিক্ষাটাই বড়ো হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমাজের প্রতিটা স্তরে যেমন শ্রেণি বিভাজন আছে, কমিউনিটির মধ্যেও তাই। যাঁরা ক্ষমতা পাচ্ছেন, তাঁরা আর বাকিদের ফিরে দেখছেন না। তৃতীয় লিঙ্গ প্রান্তিক, কিন্তু প্রত্যেকে নয়।
• আপনি একটি এনজিও’র প্রধান- মৈত্রী সংযোগ সোসাইটি। সেখানে কাজের সূত্রে গ্রাম বা মফস্সলের মানুষদের কতটা পাশে পেয়েছেন?
গ্রামের সমস্যাটা একটু অন্য ধরনের। শহরের একটা সুবিধা হল তুমি সায়েন্স সিটিতে কী করছ, সেটা বালিগঞ্জের লোকটা জানতে পারছে না। কিংবা তোমার পাশের ফ্ল্যাটের লোকটাও জানে না। কিন্তু গ্রাম যেহেতু একটা ছোট্ট পরিসর, সেখানে সবাই তোমার খবর রাখছে। ওখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতাটা খুব কম। আমাদের মূল লক্ষ্য হল জীবিকা। একটা মানুষ তখনই স্বনির্ভর হতে পারে, যখন তার হাতে টাকা থাকে। একমাত্র অর্থই পারে সমস্ত অপবাদ ঢেকে দিতে। আমরা বিভিন্নরকম হাতের কাজ করে থাকি। ২০১৯-এর শেষ দিকে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও করছি। এনজিও’র সবাইকে তাই জীবিকার উপরেই জোর দিতে বলছি।
• আমার শেষ প্রশ্ন- অরিন্দম থেকে সুমি। এখন অরিন্দম নামক ছেলেটিকে মিস করেন?
আমি কিছুই মিস করি না। কারণ এখনও আমার আত্মীয়স্বজন অরিন্দম বলে, আমার ভাই আমাকে ভাই বলে ডাকে। আমি বেশ এঞ্জয় করি। কারণ দুটোই তো আমি। অরিন্দমও আমি, সুমিও আমি। অরিন্দম হয়ে না জন্মালে সুমি হতে পারতাম না।