ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার ছিলেন এই বঙ্গসন্তান

ভোট হলেই নিরপেক্ষতা নিয়ে একের পর এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয় নির্বাচন কমিশন। সবেমাত্র শেষ হল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ২০২১। গোটা ভোটপর্বেই কমিশনের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ এনেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এমনকি কোভিড সংকটে ‘গা ছাড়া মনোভাব’-এর জন্য তুলোধনা করেছে মাদ্রাজ হাইকোর্ট।
দেশের গণতন্ত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অনেকটা মেরুদণ্ডের মতো। যদি এই প্রতিষ্ঠানের গায়ে দাগ লাগে, তাহলে গণতন্ত্র এবং সংবিধানও বিপন্নতার মুখে দাঁড়ায়। এখন খানিকটা সেরকম অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। তবে আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর যখন নির্বাচন কমিশন গঠিত হল, পরিস্থিতি কিন্তু এরকম ছিল না। প্রথম নির্বাচন কমিশনার ছিলেন একজন বাঙালি। বজ্রের মতো দৃঢ়ভাবে তিনি ভোট পরিচালনা করতেন। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে এত সুষ্ঠুভাবে প্রথমবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল, তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল গোটা দুনিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ফ্রাংকলিন রুজভেল্টের স্ত্রী ইলিনর তখন ভারত সফরে এসেছিলেন। আকাশবাণীর এক অনুষ্ঠানে তিনি মন্তব্য করেন, “ভারত এক নিদারুণ পরীক্ষা দিয়েছে এবং সেই পরীক্ষায় সম্পূর্ণ সফল।”
স্বাধীনতার পর দেশজুড়ে নানা সমস্যা দেখা দেয়। একদিকে উদ্বাস্তুদের চাপ, অন্যদিকে নাগরিকদের বিশাল অংশের সীমাহীন দারিদ্র। জাতপাত-সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তো আছেই। এসবের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করা ছিল খুব বড়ো চ্যালেঞ্জ। ভোট পরিচালনার জন্য দরকার নির্বাচন কমিশন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিল। কে নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্য, তাই নিয়ে বিধানচন্দ্রের কাছে পরামর্শ চাইলেন নেহরু। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব ছিলেন সুকুমার সেন। তাঁকেই সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করেছিলেন ডাক্তার রায়। প্রধানমন্ত্রীকে সেকথা জানালেন। ১৯৫১ সালে গঠিত হল ভারতের নির্বাচন কমিশন। প্রথম নির্বাচন কমিশনার হলেন সুকুমার সেন।
আমরা কিন্তু ভাষাবিদ সুকুমার সেনের কথা বলছি না। ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন ছিলেন অঙ্কবিদ। ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অন্য দুই ভাইও ছিলেন কৃতি। অশোককুমার ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী। ভারতের আইনমন্ত্রীর ভূমিকাও পালন করেছেন। ছোটোভাই অমিয়কুমার নামকরা ডাক্তার। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকালে তিনিই ছিলেন চিকিৎসক। সুকুমার পড়াশোনা করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গণিতে স্বর্ণপদক অর্জন করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯২১ সালে যখন আইসিএসের কাজে যোগ দেন, বয়স ছিল মাত্র ২২।
ভারত স্বাধীন হলে পরপর দু’টি সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার গুরুদায়িত্ব সামলেছেন সুকুমার সেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে প্রথমেই তিনি জানিয়ে দেন, তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। বিশাল এই দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ তখন নিরক্ষর। যাঁরা আগে কখনও ব্যালট বাক্স বা পেপার চোখে দেখেননি, তাঁরা যাতে ভোট দিতে পারেন, সুনিশ্চিত করতে হবে। সারা দেশের প্রতিটি অংশে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বন্দোবস্ত করতে হবে। লোকসভার পাশাপাশি প্রত্যেক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে।
ভোটারদের তালিকা বানাতে গিয়ে সামনে এল নানা বিপত্তি। গ্রামের অনেক মহিলাই নিজেদের নাম বলতে চান না। কেউ ‘শ্যামলের বউ’ হিসেবে পরিচিত, কেউ বা ‘রহিমের মা’, আবার কেউ ‘সুরিন্দরের মেয়ে’। সুকুমারবাবু কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন, এভাবে চলবে না। নিজের নাম বলতে হবে। প্রায় ২৮ লাখ নাম বাতিল হল এই কারণে। আমজনতা কীভাবে ভোট দেবেন, তা বোঝাতে প্রত্যেক নির্বাচন কেন্দ্রে পর্দা টানিয়ে ভিডিও দেখানো হয়। রেডিওতেও প্রচার চালায় নির্বাচন কমিশন। সুকুমারবাবু নিজে ঘুরে বেড়ালেন দেশের কোণে কোণে।
১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। সে যেন এক উৎসব। ভোটারদের যাতে সুবিধে হয়, আলাদা আলাদা দলের জন্য আলাদা আলাদা রঙে ব্যালট বাক্স ছিল। ১৯৫৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ওই বাক্সগুলিই ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন: ভোট শেষ, তারপর?
এদিকে আফ্রিকার দেশ সুদান সবে স্বাধীন হয়েছে। সেখানেও নির্বাচন আয়োজন করা দরকার। সুদান সরকার প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে আবেদন করল, নির্বাচন পরিচালনা করুন সুকুমারবাবু। সেই দায়িত্বও সুকুমার সেন দক্ষ হাতে সামলেছেন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ভারতের নির্বাচন কমিশনারের পদে ছিলেন তিনি। ভারত সরকার তাঁকে ভূষিত করে পদ্মভূষণ পুরস্কারে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে শেষ জীবন কাটান এই অঙ্কপাগল লোকটি। প্রয়াত হন ১৯৬৩ সালে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত আমাদের দেশ। সুকুমার সেনের হাতেই ভারতীয় গণতন্ত্রের সূচনা। কিন্তু আজ কতজন বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে?
তথ্যঋণ – তাপস গঙ্গোপাধ্যায়, প্রীতম বিশ্বাস, অভিজিৎ দাস।