No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এক দশক পুরোনো ‘নতুন কবিতার বই’

    সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এক দশক পুরোনো ‘নতুন কবিতার বই’

    Story image

    ‘এই যদি হয় আসল চেহারা
    রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্বর
    হেঁকে বলি তাকে, পাজির-পা-ঝাড়া
    যমে নিক তোকে, ধুত্তোর

    সমানে গুঁতোয় ধর্মের ষাঁড়ে
    ত্রাহিরব জাতিসত্তায়
    মহাভারতকে তুলে নিয়ে ঘাড়ে,
    হাঁকে : রাম নাম সত্ হ্যায়৷৷’

    শঙ্খ ঘোষের কাছ থেকে ধারালো একটি দু’ফলা ভর্ৎসনা সম্প্রতি আমার প্রাপ্তি হয়েছে৷ ঘটনাটা এ রকম - এক সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে গিয়েছি৷ একটা ছোটো কাজ ছিল৷ আর একটা অধীর আগ্রহ — আমার নতুন কবিতার বই ওঁকে দিয়ে এসেছিলাম পড়ার জন্য, পড়েছেন কী, পড়লে, কেমন লাগল? সেই প্রসঙ্গেই কথায় কথায় বললাম, ‘মনে হয় না কোনও বিক্রি বাটা হচ্ছে, বেচারা প্রকাশকের জন্য খারাপ লাগছে৷ আমার কবিতার বই কে আর কিনে পড়বে?’ উনি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুভাষদার (মুখোপাধ্যায়ের) শেষ কবিতার বই কী ছিল জানো?’

    এই হলো ভর্ৎসনা এক৷ উত্তরটা জানি না৷ বাংলা কবিতায় আগ্রহী কেউ যদি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সব ক’টি কবিতার বই না পড়ে থাকে, সেটা লজ্জার৷ আমার ক্ষেত্রে  লজ্জাটা অপরাধও বটে, কারণ এ বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে কবির জন্মের শতবর্ষ উপলক্ষে আমরা ‘এই সময়’ সংবাদপত্রের ‘রবিবারোয়ারি’-র দু-দুটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিলাম, যাতে ছিল শঙ্খ বাবুর দু’ কিস্তিতে প্রকাশিত একটি বেশ বড়ো সাক্ষাৎকার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার বিষয়ে, আর সে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি৷ একজন কবির একটা আস্ত বইয়ের একটি কবিতাও না পড়ে তাঁর বিষয়ে শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার নিতে চলে যাওয়া খুব শ্লাঘার বিষয় হতে পারে না৷

    ভর্ৎসনা দুই৷ এরপর উনি বললেন, ‘কিছু দিন আগে সুভাষদার শেষ বইটা একবার দেখার দরকার হয়ে পড়েছিল৷ দেখলাম হাতের কাছে নেই৷ অপুকে (দে’জ পাবলিশিংয়ের কর্ণধার শুভঙ্কর দে) ফোন করাতে পাঠিয়ে দিল৷ খুলেই মনটা এত খারাপ হয়ে গেল! দেখি প্রায় দশ বছর আগের সংস্করণ এখনও চলছে৷ বিক্রি হয়নি৷’ মনে হয় না জীবনে আর কখনও নিজের কবিতার বই বিক্রি না হওয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করবো কারও কাছে৷ আমরা সকলেই বোধহয় জটায়ুর মতো হয়ে যাচ্ছি, তোপসের ভাষায় — উনি নিজের লেখা ছাড়া আর বিশেষ কিছু পড়েন না! নইলে এমনটাও হতে পারে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার বই, মাত্র ৫০ টাকা দাম, একটা গোটা দশকে তার একটা সংস্করণ ফুরোলো না?! লজ্জা নয়?

    লজ্জা ঢাকতে পরের দিনই সে বই দে’জ থেকে কিনেছি৷ ভর্ৎসনার পথ বেয়ে পরম প্রাপ্তি৷ তিনটি অংশে বিভক্ত এই বইতে রয়েছে ৩৭টি কবিতা৷ প্রকাশকের কথা৷ একেবারে শেষে ‘পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গে’, যা কোনও অংশে কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়৷ যেমন, প্রথমাংশের কবিতাগুলির পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গে বলা আছে, ‘যেসব পাণ্ডুলিপি থেকে বইটি তৈরি হল, কবিতা ছাড়াও একটি দুটি বাড়তি শব্দ সেখানে লেখা আছে৷ শব্দগুলি প্রধানত কোনও পত্রিকার নামনির্দেশ৷’ মানে যে সব পত্র-পত্রিকায় কবিতাগুলি আগে প্রকাশিত হয়েছিল৷ এই তালিকায় প্রথম এন্ট্রি-টি হল এ রকম — পেরেছ যখন দাঁড়াতে (এটা কবিতার নাম): যাদবপুর বাজার সমিতি৷ আন্দাজ করছি স্যুভেনির গোছের কিছু নিশ্চয়ই৷ আর ভাবছি, আমার বাড়ির কাছের মুকুন্দপুর বাজার সমিতি যদি আমার কাছে কবিতা চাইতে আসত, আমি দিতাম? সুভাষ মুখোপাধ্যায় দিয়েছিলেন৷ এই ছোট্টো এন্ট্রিটাতেই যেন গোটা মানুষটাকে ধরা আছে৷

    আর সূচি অনুযায়ী থাকার কথা ছিল, ‘৬৬ ও ৬৭ পৃষ্ঠার মধ্যবর্তী অংশে’ ‘তিনটি পাণ্ডুলিপির ছবি’ - নেই৷ স্রেফ সাদা পাতা৷ সাবাশ, বাঙালি পাঠকের সঙ্গে তাল ঠুকে যোগ্য বাঙালি প্রকাশক! দেবব্রত ঘোষের প্রচ্ছদটি খুব সুন্দর৷

    এবার কবিতার কথা৷ সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হন ২০০৩ সালের ৮ জুলাই৷ একটি কবিতার নাম ‘গঙ্গাযাত্রীর কিছু ব্রেণ ওয়েভ’৷ পাণ্ডুলিপিতে সে কবিতার পাশে লেখা - ১৪/৬/২০০৩৷ Woodburn Ward. S.S.K.M. Hospital৷ বোঝাতে চাইছি, এই কবিতাগুলি একেবারে মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে লেখা৷ (যদিও বইটি প্রকাশিত হয় মৃত্যুর ছ’ বছর পরে)৷ প্রায় প্রতিটা কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে কবি কী পরমাশ্চর্য এক মুন্সিয়ানায় চলে যেতেই হবে এইবারে, হবেই, এই গভীর বিষাদের ওপর দিয়ে তরতরে পাহাড়ি নদীর আনন্দময় ভাষা বইয়ে দিয়েছেন৷ বিষাদটা দেখা যাচ্ছে টলটলে সেই শব্দবিন্যাসের নিচে —

    ‘‘গোধূলি’’

    কানে ধরে তালা
       হাড়ে ধরে জং
          ঘাড়ে ভারী বোঝা

    পেছন ডাকছে
         ও কে, আ মোলো যা —
         চোখের পাতায় গোধূলির রং

    উঠোনের কোণে
         পড়ে আছে মুখ থুবড়ে লাঙল
            গতরে নাইকো আগের সে বল

    যাবার সময়
         রয়ে গেল খেদ
            অর্ধেক ক্ষেত এখনও পতিত

    যা পেয়েছি, তাও বড়ো কম নয়
           তুলেছি ফসল
              আশার অতীত

    চোখে ছানি পড়ে
          হাতে পায়ে খিল
            ভাঙি নাকো কুটো
                  শূন্য তবিল

    শ্রীহরি সহায়
        তাই মিলে যায়
           দুবেলা দুমুঠো

    হাঁটু মুড়ে দিন চাইছে বিদায়
    চিল চিৎকারে
    কে শাঁখে ফুঁ দেয়?

    আর এত বাঙালি, এত নিবিড় বাঙালি এই লেখা৷ আর এত সহজিয়া রোম্যান্টিক৷ যা পড়লেই — কেবল হারাই হারাই বাজে হিয়া! কী ভাবে তৈরি করে ফেলেন কবি এই শব্দবিন্যাস, এই সিনট্যাক্স? 

    আষাঢে়

        শেষ হয়েও শেষ হতে চায় না
    আষাঢ় বেলা

    চমকে ওঠে আকাশে মেঘ
    ফের বৃষ্টির পালা

    দূর পাল্লা
        লম্বা পাড়ি
    হারানো খেই
           এই-ভাব এই-আড়ি
              হৃদয় জুড়ে সব-পেয়েছির দেশে
                  পরনে আলখাল্লা
                       এক ফকির

    মাথায় জট
        জড়ানো পট
             অন্তহীন স্মৃতির৷৷

    ম্যাজিকের মতো সহজ আর স্বাভাবিক আর অবিশ্বাস্য বিশ্বাসযোগ্য৷ আমার দুর্ভাগ্য যে ছন্দের ব্যাকরণটা আমি অ্যাকাডেমিকালি কখনও শিখিনি, নইলে তা নিয়েও দু’কথা ভেঙে বলতে পারতাম৷ আশা করি অন্য কেউ বলবেন৷ 

    এ সঙ্কলনের সব কবিতাই মোটামুটি এমন চলনের হলেও, মোটেই কিন্তু এমন বলনের নয়৷ যেমন এ লেখার এক্কেবারে গোড়ায় উদ্ধৃত কবিতাটি৷ ওটা চারটে কবিতার একটি গুচ্ছের চতুর্থ কবিতা৷ এ কবিতাগুচ্ছের হিম্মত আর উদ্দেশ্য শিরোনামেই স্পষ্ট —  ‘দেয়ালে লেখার জন্য / এ পিঠে’৷

    ‘এ পিঠে’ ? বিলকুল৷ আর একটা পিঠ আছে, তাতে আছে অন্য লেখা৷ হয়তো বা এমনই স্পষ্ট৷ কবি তা বিলক্ষণ জানেন৷ লড়াইটা সেখানেই৷ মানে, আমি অন্তত সে ভাবেই পড়েছি ৷ খাপ খোলা, চাঁছা ছোলা - 

    যদি 
    অটল হন মোদি
    বইবে রক্তনদী

    অথবা
         মোদি অটল
    হা রাম! তোবা তোবা
    দেশ তুলবে পটল৷৷

    এই ফ্যাসিবাদী আস্ফালনের দিনকালে, ও লেখা ফেসবুকে পোস্ট করলে গ্রেপ্তার করার ধারা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে রয়েছে, ইদানীং আশঙ্কাও৷ আর সেই জন্যও, হয়তো বা আজকের দিনকালে সেই জন্যেই, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে ফিরে ফিরে যাওয়া দরকার৷ বারবার৷

    ভালো কথা বইটার নামটাই বলা হয়নি৷ কবির মৃত্যুর পর মিলেছিল একটা খাম, ভিতরে কবিতার পাণ্ডুলিপি, ওপরে কবির নিজের হাতে লেখা, ‘নতুন কবিতার বই’৷ সেটাই নাম৷ 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @