সুভাষচন্দ্র বনাম অধ্যাপক ওটেন, দু’জনের জীবন বদলে দিয়েছিল যে ঘটনা

২০১৫ সালে নরওয়ের চলচ্চিত্রকার আরল্যান্ড হুগেন একটি চিত্রনাট্য লিখছিলেন অধ্যাপক এডওয়ার্ড ফার্লি ওটেনকে নিয়ে। ওটেন যে শহরে থাকতেন, সেই টানব্রিজ ওয়েলসের কিছু গবেষক এবং ইতিহাসবিদের সাহায্য চান এই ব্যাপারে। ১৯ বছরের ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে ওটেন স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন ভারতের ইতিহাসে। সেটা ছিল ১৯১৬ সাল। অনেক বছর পরে সেই ছাত্রের জন্যই একটি শোক কবিতা লিখেছিলেন ওটেন।
বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের মতে শিক্ষক ওটেনের জীবন পালটে দিয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের সেই ঘটনা। জানা যায়, উদ্ধত এবং বর্ণবিদ্বেষী আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে সুভাষ এবং আরও কয়েকজন ছাত্র তাঁকে শারীরিক আক্রমণ করেন। ফেলে দেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রধান সিঁড়ি থেকে। এই বিবরণের পুরোটা হয়তো ঠিক নয়। তবে, সুভাষকে বহিষ্কার করা হয় কলেজ থেকে।
সুগত বসু ‘His Majesty’s Opponent’ বইতে লিখছেন, প্রেসিডেন্সির ওই ঘটনা সুভাষের জীবনও বদলে দিয়েছিল। সেব্যাপারে নিজেও সচেতন ছিলেন তরুণ সুভাষ। প্রায় ৩ দশক পরে আত্মজীবনীতে সুভাষ লেখেন, “রাতে ট্রেনের বাংকে শুয়ে শেষ কয়েক মাসের ঘটনা আমি পর্যালোচনা করছিলাম।” এই উদ্ধৃতি দিয়ে সুগত বসু যোগ করছেন, “he realized that his expulsion from college had given him ‘a foretaste for leadership though in a very restricted sphere - and the martyrdom that it involves’.”
সবাই জানেন যে এই ঘটনাই অধ্যাপক ওটেনকে কুখ্যাত করে দিয়েছে। যদিও কেরিয়ারে তিনি সফল, তবে অমরত্ব পেয়েছেন সুভাষচন্দ্রের জন্যই। সিনেমা পরিচালক হুগেনের মতো অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে, তারপর ওটেনের কী হল? শারীরিক হেনস্থার পর তিনি গেলেন কোথায়?
উত্তর খুঁজতে গেলে আরম্ভ করতে হয় গোড়া থেকে। এডওয়ার্ড ফার্লি ওটেনের জন্ম টানব্রিজ ওয়েলসে। ১৮৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর। ভবিষ্যৎ ছাত্রের থেকে ১৩ বছরের বড়ো ছিলেন, ৩২ বছর বয়সে যাঁর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সংঘাতে। ওটেন ছিলেন লেখাপড়ায় দুর্দান্ত। কলেজে ইতিহাস এবং গ্রিক-রোমান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ইন্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিসে যোগ দিয়ে কেরিয়ার শুরু করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। ক্রমেই হতে থাকে পদোন্নতি। পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের ডিরেকটরের পদও লাভ করেছিলেন। কিন্তু এই যাত্রাপথের কোনও এক সময়ে ভারতীয় দর্শন এবং বাংলা সাহিত্যে আগ্রহ জন্মায় তাঁর। এমনকি বাংলার পাঠ নিতে থাকেন প্রখ্যাত অর্থনীতিক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে। প্রমথনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব সামলেছেন ১৯৪৬-৪৯ সালে।
উদ্ধত, অমার্জিত বর্ণবিদ্বেষী অধ্যাপক ওটেন পালটে গিয়ে হয়ে যান ভারতপ্রেমী। গভীর ভালোবাসা থেকেই ভারতবর্ষ নিয়ে লিখেছেন একের পর এক বই ‘Anglo Indian History’, ‘Glimpses of India’s History’, এবং ‘European Travellers in India’। অবসরের পর ইংল্যান্ডে গিয়েও প্রমথনাথের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। চিঠি লিখতেন স্পষ্ট বাংলায়। টানব্রিজ ওয়েলসেই তিনি প্রয়াত হন ১৯৭৩ সালে। আমরা কখনও জানতে পারব না, ভারতের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ কীভাবে পরিণত হল গভীর ভালোবাসায়।
কিশোর সুভাষচন্দ্র
এখানেই কথা শেষ করা যেত, কিন্তু সামান্য কিছু তথ্য না জুড়লেই নয়। অধ্যাপক ওটেন কবিতাও লিখতেন। ২০১৫ সালে হুগেন এক স্থানীয় সংবাদপত্রকে বলেন, “স্থানীয় ইতিহাসবিদরা যদি ওটেনের কোনো পূর্বপুরুষ কিংবা তাঁর অন্য কোনো কবিতার খোঁজ পান, তাহলে সাদরে গৃহীত হবে।” তাঁর একটি কবিতার সন্ধান অবশ্য পাওয়া গিয়েছে। যে ছাত্র হেনস্থা করেছিলেন, সেই সুভাষকে নিয়েই। ১৯৪৫ সালে তাইহুকু বিমান দুর্ঘটনা এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হলে ৬১ বছর বয়সী ওটেন এই শোক কবিতা লেখেন –
Did I once suffer, Subhas, at your hands?
Your patriot heart is stilled, I would forget!
Let me recall but this, that while as yet
The Majesty that you once challenged in your land
Was mighty; Icarus-like your courage planned
To mount the skies, and storm in battle set
The ramparts of High Heaven, to claim the debt
Of freedom owed, on plain and rude demand.
High Heaven yielded, but in dignity
Like Icarus, you sped towards the sea.
Your wings were melted from you by the sun,
The genial patriot fire, that brightly glowed
In India's mighty heart, and flamed and flowed
Forth from her Army’s thousand victories won!
প্রেসিডেন্সির সেই ঘটনার ৩০ বছরেরও বেশি পরে লেখা কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে সুভাষের প্রতি শ্রদ্ধা। যত না শোকজ্ঞাপন, তার থেকেও বেশি ক্ষমাপ্রার্থনা। বিশেষ করে মন ছুঁয়ে যায় গ্রিক বীর ইকারাসের সঙ্গে তুলনা। যিনি মোম দিয়ে শরীরে ডানা লাগিয়েছিলেন, কিন্তু বারণ না শুনে সূর্যের কাছাকাছি চলে যান। মোম গলে তিনি পড়ে যান সমুদ্রে।
সম্ভবত এই রূপক দিয়ে সুভাষের মৃত্যুভয় জয় করা সাহসকে ইঙ্গিত করেছেন ওটেন। দেখাতে চেয়েছেন কীভাবে স্বপ্ন সার্থক করার লক্ষ্য নিয়ে সুভাষ অতিক্রম করেছেন মরণকে। তার চেয়েও বড়ো কথা, ফুটে উঠেছে ওটেনের অসাধারণ বিনয়। যে ছাত্রের কাছে তিনি লাঞ্ছিত হয়েছিলেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা এবং শোক ব্যক্ত করেছেন অকপট হয়ে।