No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    নৌকো ঘিরে জীবন যাঁর : বাংলার ‘নৌকো মানব’ স্বরূপ ভট্টাচার্য

    নৌকো ঘিরে জীবন যাঁর : বাংলার ‘নৌকো মানব’ স্বরূপ ভট্টাচার্য

    Story image

    নৌকোই জল আর মানুষের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিল প্রথম। কিন্তু তারপর পৃথিবীর তিন ভাগ জল বাদ দিয়ে এক ভাগ স্থলেই মানুষ গড়ে তুলেছে নিজস্ব সভ্যতা, সংস্কৃতি। তাই নৌকোর ইতিহাস অনেক পুরোনো। সুলতানি, ডোঙ্গা, ডিঙি, ময়ূরপঙ্খী, পানসি, খেড়ো, বজরা এমন কত নামের নৌকো বাংলার বুকে একসময় ভেসে বেড়াত। সেইসব নৌকোর আলাদা আলাদা ব্যবহার, আলাদা আলাদা গড়ন। বিশ্ব জুড়ে নৌকো ঘিরে গড়ে ওঠা হরেক সংস্কৃতি, ইতিহাস গ্রাম-গ্রামান্তরে, দেশ-দেশান্তরে খুঁজে বেড়ান এক নৌ গবেষক। বলতে গেলে, নৌকোই তাঁর আবেগ, প্রেম। আবার নৌকোই তাঁর জীবনচর্যা, গবেষণাও বটে।

    পশ্চিমবঙ্গের এই নৌকোপ্রেমী মানুষটির নাম স্বরূপ ভট্টাচার্য (Boat Man Swarup Bhattacharya)। পেশায় তিনি একজন নৃতত্ত্ববিদ। নৃতত্ত্ববিদ্যার সুবাদে স্বরূপ ভট্টাচার্য কাজ করেছেন দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা সংস্থায়। সে তালিকা যেমন দীর্ঘ, তেমনই উজ্জ্বল। নৌকোর ইতিহাস, সংস্কৃতি, শৈলী সবই তাঁর নখদর্পণে। তাই তাঁকে মানুষ চেনেন নৌকো মানব বলেই। নৌকো নিয়েই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ২৬টি বসন্ত। এখনও নৌকো নিয়ে তাঁর উৎসাহ অপরিসীম।

    নৌকোর সঙ্গে স্বরূপ ভট্টাচার্যের সম্পর্ক গড়ে উঠল কীভাবে? উত্তর কলকাতার বাগবাজারের এক শিল্পী বাড়িতে তাঁর জন্ম। শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি নৃতত্ত্বের দিকে ঝুঁকেছিলেন। ১৯৯৫ সালে মাস্টার ডিগ্রি করার পর তাঁর হাতে একটি প্রজেক্ট আসে। বস্তুত সেটিই ছিল তাঁর জীবনের নৌকোপ্রীতির মূলে। ১৯৯৭ সাল থেকে সেই প্রজেক্টের সুবাদেই তিনি নৌকোর সঙ্গে যুক্ত হন। এবং ধীরে ধীরে নৌকো নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যেমন একদিকে বাংলার নৌশিল্প এবং তার কারিগরদের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছেন, অন্যদিকে সারা বিশ্বের নৌ ইতিহাস, বিবর্তন তিনি জানতে পেরেছেন তাঁর পেশা এবং নেশার সুবাদে। তাই বাংলা থেকে ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি পর্যন্ত ছুটে গিয়েছেন নৌকোর বিবর্তন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জানতে। 

    বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে নৌকোর অভিন্ন সম্পর্ক। অতীতে নৌ বাণিজ্যে নাম কুড়িয়েছিল বাংলা। তাও নৌকোর ব্যবহার কমে যাচ্ছে। তাহলে নৌকো কি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে? বঙ্গদর্শন.কম-কে স্বরূপবাবু বলেন, “নৌকোর ব্যবহার কমছে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে যত সংখ্যক নৌকো ছিল, সেই সংখ্যাটা অনেক কমে গেছে এবং ভবিষ্যতে আরো কমবে। তবে যতদিন জল আছে, মানুষের মাছ ধরা আছে, নৌকো থাকবেই।”

    নৌকা কত রকমের? তার কতটা আন্দাজ আজ পাওয়া যেতে পারে? তিনি বলেন, “নৌকো কত রকমের বা কোথায় কোথায় কী কী নৌকো চলে, সেটা জানার চেষ্টাও বিশেষ হয়নি। ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে ১৭৯টি নৌকোর মডেল রাখা আছে। অর্থাৎ ব্রিটিশরা এইসব মডেলগুলো সংরক্ষণ করেছিল। আজ থেকে ১০০ বছর আগে তার মানে এইসব নৌকগুলো চলত। আমার ধারণা, আরও বেশি সংখ্যক নৌকো চলত। পশ্চিমবঙ্গে আমি কাজ করে দেখেছি ৩০ রকমের নৌকো ছিল। তার অনেকগুলোই শেষ হয়ে গিয়েছে আজ। আর ব্যবহার হয় না বলে সেই নৌকোগুলো বানানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে আমরা জানি না যে ১০০ বছর আগে ৩০ সংখ্যাটা ১০০ বা তার বেশি ছিল কিনা।”

    সারা পৃথিবীরই খুব প্রাচীন ঐতিহ্য এই নৌকাবাইচ। সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে অর্থাৎ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চিন, ভারত সব জায়গায় এই বাইচ খেলা হয়ে আসছে অনেক কাল আগে থেকে। প্রাচীন বাংলার নৌকা বাইচের কথা পাওয়া গেছে সাহিত্যে। লৌকিক দেবী মনসার ভাসান বা মনসা পুজোকে কেন্দ্র করে তাই দুই বাংলাতে বাইচ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কালের নিয়মে বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে, তবে বাংলাদেশের মতো না হলেও পশ্চিমবঙ্গেও কিছু জায়গায় বাইচ খেলা হয় এখনও। এ প্রসঙ্গে স্বরূপবাবু বলেন, “সুন্দরবন, নদিয়া, মুর্শিদাবাদের কিছু কিছু অংশে একটা সময় বেশি বাইচ খেলা হতো। এখন খুবই কমে গেছে। কারণ, এই সংস্কৃতি নষ্ট হওয়ার মুখে। বাইচ খেলার নৌকো একদম আলাদাভাবে তৈরি করতে হয়। সেই নৌকো এখন আর কেউ বানাচ্ছে না। ফলে আগামী দিনে খেলার নৌকো থাকবে না। এই মুহূর্তে সুন্দরবনের দিকে পাঁচখানা বাইচ খেলার নৌকো আছে। এখনো মালঞ্চ, কচুখালী, ন্যাজাট, সূর্যবেড়িয়ার মতো সুন্দরবনের বেশ কিছু জায়গায় টিকে আছে এই বাইচখেলা।”

    নৌকা নামক জলযানের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্যকে আঁকড়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছেন স্বরূপ ভট্টাচার্য। ডেনমার্কের ভাইকিং শিপ মিউজিয়াম, কাঁকুড়গাছির ‘হেরিটেজ বোটস অফ বেঙ্গল’ গ্যালারি থেকে হুগলির বলাগড়ের নৌশিল্প (দুশো বছরের প্রাচীন নৌ-শিল্পের আস্তানা হুগলির বলাগড়) ও তার কারিগর-- সবরকম অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে মজুত। বঙ্গদর্শন.কম-কে শোনালেন তাঁর অভিজ্ঞতা। বেনারসের বেনারসি, কাশ্মীরের পশমিনা, লখনৌয়ের চিকনের মতোই বলাগড়ি ডিঙি জগৎ বিখ্যাত। তাঁর মতে, “বলাগড়ের কমবেশি ২০টা কারখানা সারা বছর নৌকা বানায়। চাহিদা অনুযায়ী সেটা ৩০-৩৫ এ-ও পৌঁছে যায়। বেশিরভাগ নৌকো তৈরি হওয়ার পর কারখানা অর্থাৎ নৌ কারিগরের বাড়িতেই সাজিয়ে রেখে দেয়া হয় ক্রেতার অপেক্ষায়। ক্রেতা নৌকাটা কিনে নিলে রিকশা ভ্যান অথবা নদীপথে পৌঁছে দেওয়া হয়।”

    কবি মনসামঙ্গলে বিশ্বকর্মাকে দিয়ে সমুদ্র যাত্রার উপযুক্ত সপ্তডিঙ্গা বানিয়েছিলেন বলে কথিত। সেই বিশ্বকর্মা বা নৌকো কারিগরদের জীবন ও কাজ তিনি দেখেছেন কাছ থেকে। বলাগড় বাদ দিয়ে নৌ-কারিগরদের সামগ্রিক চিত্রটা কেমন?

    তাঁর বক্তব্য, “নৌকোর মিস্ত্রি চিরকাল কমই ছিল। তবে ইদানীং নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে, খেয়া পারাপারের বদলে এখন ব্রিজ পেরোয় মানুষ, তাই নৌকোর চাহিদা কমেছে। পেশা পাল্টে নৌ কারিগরেরা এখন ইটভাটায় বা দৈনিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। নৌকোর অর্ডার এলে তবেই তারা নৌকো বানায়। দক্ষতানির্ভর একটা পেশা এভাবে কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে।”

    একসময় পারানি বা কড়ির বিনিময়ে নৌকা পারাপার হত। জলপথে বাণিজ্যতরীর উপর নির্ভর করত রাজ কোষাগার। সবই এখন অতীত। তাই বাংলার নৌবহর, নৌ বাণিজ্য, নৌ নির্মাণের ধারা ক্রমেই শুকিয়ে এসেছে।

    তাই ভালো নেই নৌ কারিগরেরা। তিনি বলেন, “৭০ বছরের নৌ কারিগর পঞ্চানন মণ্ডল সারা জীবনে ১০০-র বেশি নৌকা বানিয়েছেন। অথচ গত ৩০ বছরে তিনি একটা দুটো সারাই করেছেন মাত্র। নতুন কিছু বানাননি। তার মানে আগের ৪০ বছরে এই সংখ্যক নৌকো বানিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে যে শৈলী, দক্ষতা, অভ্যেস সব ক্ষেত্রেই কারিগররা আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছেন।”

    স্বরূপ ভট্টাচার্যের সহজ ভাষায় অনর্গল নৌকো নিয়ে কথা বলার দক্ষতা দেখলে চমকে যেতে হয়। তাঁর সঙ্গে নৌকো নিয়ে আলোচনা করলে মনে হয় তিনি যেন বাঙালির স্মৃতিসরণি ঘুরে ঘুরে হেঁটে বেড়ান নদীবিধৌত বাংলায়। যে বাংলায় মাঝিমাল্লার ভাটিয়ালি, সারি, নৌকাবাইচের গান থেকে গোয়ালন্দ স্টিমার কারি — বাঙালির ফেলে আসা দিনের ঐতিহ্য আর সুগন্ধ বয়ে নিয়ে যায়। সেই বাঙালির জীবনচর্যায় স্বরূপবাবু জুড়েছেন নৌকোপ্রেম। তাই তাঁর তৈরি অজস্র নৌকোর মডেল আমাদের চোখে হয়ে ওঠে বাংলার মঙ্গলকাব্য বা রূপকথার প্ৰপ। পানসি, ময়ূরপঙ্খী কিংবা বজরায় চেপে ফিরে যাই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে অচিন বাংলায়।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @