কলকাতার হোয়াইটআওয়ে লেইড্লের রাজকীয় গপ্পেরা

লোকে বলে, কলকাতায় চাইলে নাকি বাঘের দুধও মেলে। কথাটা খুব মিথ্যে নয়। এতরকম বাজার, এত হরেক দোকান, রাস্তার মোড়ে, ফুটপাতে, বাসে-ট্রামে চলমান দোকান-- পাওয়া যায় না কী এখানে? তবে, সব দোকানের তো আর বনেদি হওয়ার সুযোগ মেলে না। কিছু কিছু দোকানপাট বনেদিয়ানার চিরকালীন আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই সুনামটি যেন তার একচেটিয়া। চৌরঙ্গীর মোড়ে যেমন দাপটে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো দোকানটি- হোয়াইটআওয়ে লেইড্ল। ইংরেজিতে যাকে বলে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। তবে তার নাম এখন মেট্রোপলিটন বিল্ডিং। বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে ছড়ানো। আকাশচুম্বী সোনালি গম্বুজ, চারদিকে বিস্তৃত চারটি বাহু, খিলান-আঁটা প্রবেশপথ, আবার একটি ক্লক টাওয়ার। কী বিশাল সেই অট্টালিকা! এসপ্ল্যানেড মেট্রোস্টেশনে নামলেই দেখা যাবে এর সোনালি, চকচকে চুড়োটি। একে অবজ্ঞা করার সাধ্য নেই কারো। স্টোরটি নেই ঠিকই। তবু এই শহরের প্রাচীন বাসিন্দাদের কাছে তার স্মৃতি আজও অমলিন।
যেসময় এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের নির্মাণ, সেসময় কিন্তু কলকাতায় খোলা বাজারের কমতি ছিল না। অনেক ভালো জিনিস কম দামেও মিলত সেখানে। তবু আজকের জমানায় যেমন ব্র্যান্ডনেম-এর খুব হইচই, বিশ শতকের গোড়াতেও ছিল তাই। হোয়াইটআওয়ে লেইড্ল বললেই চোখ চকচক করে উঠত। আর স্টোরটির অসামান্য সাজসজ্জা ছিল ক্রেতার কাছে উপরি পাওনা। অনেকটা ফাউ-এর মতো।
রবার্ট লেইড্ল ছিলেন এই স্টোরটির প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৫৬-তে জন্ম, প্রথমে ছিলেন লন্ডনের কাপড় বিক্রেতা। পরে ১৮৭৭-এ আসেন কলকাতায়। ১৮৮২-তে কলকাতায় তাঁর ব্যাবসা শুরু। টানা কুড়ি বছর এখানে থাকেন। তবে, এই সময়পর্বে এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গাতেই ঘুরেছিলেন লেইড্ল। রয়াল জিয়োগ্রাফিক সোসাইটির রয়াল ফেলোও হয়েছিলেন।
জহরলাল নেহেরু রোড আর এসএন ব্যানার্জি রোডের মাঝামাঝি এই বিশাল বাড়িটি তৈরি হয়েছিল ১৯০৫-এ। বিখ্যাত ম্যাকিনটস বার্ন কোম্পানি ছিল এই অপূর্ব নির্মাণের কারিগর সংস্থা। নিও-ব্যারোক স্থাপত্যশৈলীর এই বাড়িটির আকৃতি সম্পর্কে অনেকে বলেন, ঠিক যেন ওয়েডিং-কেক।
যাইহোক, আভিজাত্যপূর্ণ এমন স্টোর সেসময় তামাম কলকাতায় ছিল না। বিশ্বের অনেক জায়গাতেই অবশ্য লেইড্ল সাহেব তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে ছিলেন। সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর। আর ভারতেও বোম্বাই, ম্যাড্রাস, লাহোর, সিমলায় ছিল তাঁদের রাজত্ব। কলকাতার এই বাড়ি তখন লেইড্ল বিল্ডিং নামেই প্রচলিত। কলকাতার নামজাদা সাহেব অফিসার, উচ্চপদস্থ কর্মচারী, সৈনিকদের ভিড়ে উপচে পড়ত এই দোকান। দেশীয় অবস্থাপন্নেরাও ভিড় জমাতেন। অভিজাত এই দোকান, বিজ্ঞাপনেও বজায় রাখত সাহেবি কেতা। তাই রেইনকোটের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত- "We can't stop the rain, but Our Raincoat Will Keep You Dry."
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয় দেশ। আর তখন থেকেই একটু একটু করে নিভতে থাকে লেইড্ল স্টোরের ঔজ্জ্বল্য। সাহেবরা সব দেশ ছাড়ে। আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরাও একে একে পাড়ি দেন মিলেত-বিলেত। ফলে পসার জমানো খুব সম্ভব হচ্ছিল না। এদেশের মানুষের তো চিরকালই অন্নচিন্তা চমৎকারা। তাও চলেছিল ১৯৬২ অবধি। তারপর চলে যায় মেট্রোপলিটান লাইফ ইন্সিওরেন্সের হাতে।
বর্তমানে বিগ বাজার, কটন ইন্ডাস্ট্রি ও আরো হাজারটা দোকানের, অফিসের আস্তানা এই রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িতে। থাকেন বহু ভারতীয়ও।
আরও পড়ুন
সিংহদুয়ার এবং আরেকটি মস্ত বাড়ির গল্প
হোয়াইটআওয়ে লেইড্লের আভিজাত্যর প্রমাণ মেলে সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতিচারণায়। ‘যখন ছোটো ছিলাম’-এ তিনি বলছেন সেকথা- “কলকাতায় তখন সাহেবদের বড়ো দোকান (আজকাল যাকে বলে ডিপার্টমেন্ট স্টোর) ছিল হোয়াইটয়াওয়ে লেইডল।... বিশাল দোতলা দোকানের পুরো দোতলাটা বড়োদিনের কটা দিন হয়ে যেত টয়ল্যান্ড। একবার মার সঙ্গে গেলাম সেই টয়ল্যান্ডে।... কিন্তু টয়ল্যান্ড যে যাব তার সিঁড়ি কই? জীবনে সেই প্রথম জানলাম লিফট কাকে বলে। হোয়াইটয়াওয়ের দোকানের লিফটটাই বোধহয় কলকাতার প্রথম লিফট। সোনালি রং করা লোহার খাঁচায় দোতলায় উঠে এসে মনে হল স্বপ্নরাজ্যে এসেছি। মেঝের অনেকখানি জায়গা জুড়ে পাহাড় নদী ব্রিজ টানেল সিগন্যাল স্টেশন সমেত খেলার রেলগাড়ি এঁকেবেঁকে চক্কর মেরে চলেছে রেললাইন দিয়ে।...”
এছাড়াও আরো হাজার রকমের খেলনার সম্ভার, আর ছিল সাদা দাড়ি, লাল পোশাকের সান্তাবুড়ো। বাস্তবিকই শিশুদের ও বুড়োদের কাছে স্বপ্নদেশই ছিল এই স্টোর। সাহেব দোকানদারদের মধুর ব্যবহারও নাকি বিশেষ আকর্ষণের ছিল সেখানে।
যাইহোক, সেসব দিন অতীত হয়েছে। আজ অবশ্য পাড়ায় পাড়ায় আশ্চর্য সব ডিপার্টমেন্ট স্টোরের হানা। জানি না, কলকাতার প্রবীন বাসিন্দারা সেসবে ঠিক হোয়াইটআওয়ে লেইড্ল-এর আমেজ পান কিনা।
প্রচ্ছদের ছবিসূত্র: https://www.flickr.com/photos/abhinaba/20560006303/sizes/l
ভিতরের ছবি: https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/3/3e/Metropolitan_Building%2C_Kolkata.jpg