রুক্ষ পাহাড়কে সবুজে ভরিয়ে তুলছে কচি-কাঁচার দল

যেদিকে চোখ যায় রুক্ষ শুষ্ক পাথুরে জমি। দূরে উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি। আর হাতের কাছেই ছোটো-ছোটো ডুংরি বা টিলা। এমনই এক রুখাশুখা পাহাড়ি দেশকে সবুজে ভরিয়ে তুলছে কয়েকজন কচি-কাঁচা। ভালিডুংরি নামের একটা টিলার গায়ে তারা লাগিয়েছে হরেক গাছের চারা। গ্রীষ্মের দাবদাহের মধ্যেই টানা জল দিয়েছে সেইসব গাছে। জেদ, বাঁচিয়ে রাখবেই সব গাছ। মরুভূমি-সম জায়গায় মরূদ্যান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদেরই হাতের ছোঁয়া পেয়ে। আর এই কচি-কাঁচাদের ঠিকানা হল ভালিডুউংরি টিলার নিচে পুরুলিয়ার আড়শা ভালিডুংরি সিধু কানু মিশন।
এক স্বপ্নের দেশ যেন এই মিশন। যে মিশনের প্রধান উদ্দেশ্যই হল সমাজের অবহেলিত নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এখানে পড়াশোনা করে একশোর বেশি ছাত্রছাত্রী। শুধু পড়াশোনাই নয়, এখানে আশ্রয়ও পেয়েছে প্রায় জনকুড়ি অনাথ শিশু। পড়ার পাশাপাশি তারা এখানে পায় দুবেলা পেট ভর্তি খাবার, মাথার উপর ছাদ আর বেঁচে থাকার, স্বপ্ন দেখার সাহস।
এমনই এক স্বপ্নের ঘোর বোনা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা লোকসংগীত শিল্পী, এই এলাকারই ভূমিপুত্র নরেন হাঁসদা। যিনি পথে পথে গান গেয়ে সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের সাহায্য নিয়ে তৈরি করেছেন এই আশ্রম। জনসাধারণের দেওয়া চাল, ডাল, সামান্য কিছু অর্থ আর কোনো কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া সাহায্যে এই আশ্রমের দিন গুজরান হয়। শত বাধাবিপত্তি, অভাবের চোখরাঙানি সত্ত্বেও এই আশ্রমের সমস্ত কচি-কাঁচারা উজাড় করে বাঁচতে শেখে। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের সংস্কৃতির চর্চা করার জন্যও তাদের প্রতিনিয়ত উৎসাহ দেন নরেন হাঁসদা। শিশুরা এখানে বেড়ে ওঠে গানে, গল্পে, ছন্দে ,কবিতায়। বেড়ে ওঠে ধমসা মাদলের বোল শুনে, পাহাড়িয়া বাঁশির সুরে।
এই মিশনই শিশুদের শিখিয়েছে, প্রকৃতিকে ভুলে বাঁচা যায় না। তাই, কুড়িয়ে পাওয়া শেয়ালছানাটি হোক কিংবা আশ্রম চৌহদ্দিতে বেখেয়ালে ঢুকে পড়া ময়াল সাপ-- কোনো কিছুর ক্ষতি না করে তাদের নিজ বাসস্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজটিও এখানেই, এই আশ্রমেই শেখা তাদের। তাই তো আশ্রমের পাশেই ডুংরির গায়ে একসঙ্গে খেলে বেড়ায় কচিকাঁচার দল। সঙ্গী হয় মেঠো ইঁদুর, খরগোশ ছানা, নাম না-জানা পাখির দল।
আবার, এই ডুংরিতে বসেই চলে পড়াশোনার পাঠ। ছবি আঁকা, গল্প, আর গানের ক্লাস। খোলা প্রকৃতির মাঝে মুক্তাঙ্গনে বসে ওরা শিখে নেয় জীবনের অ-আ-ক-খ। শিখে নেয় পিলচু হাড়াম, পিলচু বুড়ির উপকথা। কল্পনায় ওরা পৌঁছে যায় ‘হিহিড়ি পিপিড়ি’-র সেই দেশে যেখানে ওদের পূর্বপুরুষের মাটিভিটে। পিলচু হাড়াম, পিলচু বুড়ি সাঁওতাল উপকথা অনুযায়ী আদি মানব মানবী। আর ‘হিহিড়ি পিপিড়ি’ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদি বাসস্থান।
এই মুহূর্তে এখানে ব্যস্ততা তুঙ্গে। কিছুদিন পরেই বর্ষা নামবে। আর এই বর্ষায় এখানকার কচিকাঁচার দল ঠিক করেছে আশ্রম সংলগ্ন এলাকা গাছ লাগিয়ে সবুজে সবুজে ভরিয়ে তুলবে। মানুষের জীবনে গাছের প্রয়োজনীয়তা যে কতখানি তা আশ্রমের স্কুল থেকে শিখছে, জেনেছে ওরা। আর এই শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষে কেউ যেমন মাটি খুঁড়ে চারাগাছ লাগাচ্ছে রোজ, তেমনই কেউ গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভালিডুংরি এখনই গায়ে তুলেছে সবুজের পোশাক। সেই পোশাক আরো ঘন হবেই—এই এখানকার কচি-কাঁচাদের প্রতিজ্ঞা যেন।
আজকে যখন আমরা স্যোশাল মিডিয়ায় গাছ লাগিয়ে, জ্ঞান দিয়ে তোলপাড় করে দিচ্ছি, তখন এই অন্তর্জালের কল্পিত দুনিয়া থেকে বহুদূরে ওরা নেমে পড়েছে সবুজের অভিযানে। আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচাতে পারছে কিনা জানা নেই, কিন্তু পুরুলিয়ার বুকে অনেকখানি সবুজের স্বপ্ন ওরা বুনে দেবেই।
ছবি: তরুণ মাহাতো এবং নরেন হাঁসদা (ফেসবুক থেকে গৃহীত)