No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    অভাব উড়িয়ে শিবকে নিয়ে গান বেঁধেছেন ‘পরশপাথর’ তুলসী চক্রবর্তী

    অভাব উড়িয়ে শিবকে নিয়ে গান বেঁধেছেন ‘পরশপাথর’ তুলসী চক্রবর্তী

    Story image

    ‘পরশপাথরে’র সেই বিখ্যাত দৃশ্যটা মনে আছে? পাথরখানা খেলনা সেপাইয়ের গায়ে ঠেকাতেই সোনা! বিস্ফারিত চোখ নিয়ে দেখছেন পরেশচন্দ্র দত্ত। তারপর, ফেটে পড়ছেন হাসিতে। আনন্দ-লোভ-‘সব পেয়েছির’ হাসি। পরমুহূর্তেই অজানা আতঙ্ক গ্রাস করল... কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন গোবেচারা কেরানি পরেশ দত্ত। এমন অদ্ভুত ট্রানজিশন হয়তো টালিগঞ্জে একটা লোকই পারেন, পারতেন। তিনি তুলসী চক্রবর্তী। 

    উত্তমকুমারের জবানিতে, “তুলসীদা যেভাবে অভিনয় করেন, আমি তো কোনো দিনই পারব না। ওঁর মতো ‘জীবন্ত’ হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না।... প্রণাম জানানোর একটাই পথ আমার কাছে। যখনই কাজ পাই, পরিচালক প্রযোজককে বলে ওঁকে ডেকে নিই। তুলসীদা থাকলে সিনটা দারুণভাবে উতরে যায়। ওঁর ঋণ শোধ তো করতে পারব না, যেটুকু পারি সাহায্য করি।”

    অথচ টালিগঞ্জে ‘তুলসীবাবু’-র সঙ্গে নিয়মিত খারাপ ব্যবহার করতেন প্রযোজক, নির্দেশক মায় মেকআপ আর্টিস্টরাও। চরিত্রাভিনেতার দর অল্প। পেতেনও সামান্য। নিপাট ভালোমানুষ, কখনো কথার পিঠে কথা বলতেন না। সদ্ভাব সকলের সঙ্গে। নিজের কাজ সম্বন্ধে অত্যধিক বিনয়ী। প্রশংসা শুনলে বলতেন, “এই চরিত্র করার জন্য ভাল অভিনয় করার দরকার হয় নাকি? তোমার চারপাশে এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও।” অনেক ফিল্ম সমালোচক চ্যাপলিনের সঙ্গে তুলনা টেনেছেন তুলসিবাবুর। কিন্তু তাঁর অভিনয় নিতান্তই দেশজ।

    জন্মেছিলেন কৃষ্ণনগরের গোয়ারীতে। বাবার অকালমৃত্যুর পর মা-কে নিয়ে কাজের সন্ধানে চলে আসেন কলকাতায়। জ্যাঠামশাই, প্রসাদ চক্রবর্তীর ছিল অর্কেস্ট্রা পার্টি। কিশোর তুলসীর কীর্তনের গলাটিও খাসা। যে ক্ষমতার অনেকটাই দেখা যায় ‘পরশপাথরে’র সেই বিখ্যাত ‘ককটেল পার্টি’-তে। চাকরি মেলে না কোথাও। প্রথম বয়সে হেন কাজ নেই যা করেননি। মদের দোকানে বয়ের চাকরি থেকে সার্কাসের জোকার। শেষে ‘জানোয়ারের দুর্গন্ধ’ সইতে না পেরে পালিয়ে আসেন। ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ করতে করতে হাতে আসে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল। মাথায় চাপল অভিনয়ের ভূত। অভিনয় করবেন বলে ৩২ টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে মাসিক ৮ টাকা মাইনেতে স্টার থিয়েটারে ঢুকলেন। সেখানে শুরুতেই চোখে পড়ে যান কিংবদন্তি অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের। তারপর...

    বাস্তবিকই জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই পারতেন তুলসী চক্রবর্তী। নাটকে কখনো মোজায় চোখ এঁকে নাগরা জুতো বানিয়ে ফেলতেন। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ নাটকে তবলিয়া হঠাৎ কলেরায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় দিব্বি তাঁর বদলে তবলায় সঙ্গত করে দিলেন তুলসী চক্রবর্তীই। 

    শেষ জীবনটা অবধি ছিলেন নিঃস্বার্থ, পরোপকারী একজন মানুষ। তাঁরই চেষ্টায় থিয়েটারে চাকরি পান জহর গঙ্গোপাধ্যায়। বড়ো বড়ো নায়কেরা পাগলের মতো ভক্তি করতেন আমুদে মানুষটাকে। শীতে কষ্ট পাচ্ছেন শুনে অভিনেতা অনুপকুমার কিনে দিয়েছিলেন একটা কোট। আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। নিঃসন্তান মানুষটি ‘ছেলে’ বলে ডাকতেন উত্তমকুমার, তরুণকুমারকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ভালোবেসে বলতেন ‘সৌমিত্তির’। 

    অভাব থাকলেও অভিনয়ের জন্য নূন্যতম টাকা নিতেন তুলসী চক্রবর্তী। উত্তমকুমার থেকে সত্যজিৎ, সকলকেই টাকা হাতে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘অবাক পৃথিবী’-র সময় একবেলা কাজের জন্য তাঁকে দেওয়া হল তিনশো টাকা। তিনি কিছুতেই তা নেবেন না। কারণ, তখন তাঁর রেট দিনে একশো পঁচিশ টাকা। দলের অনেকের জামা-জুতো ছিঁড়ে গেলে নিজের হাতে সেলাই করে দিতেন তুলসীবাবু। অবসর সময়ে পৌরোহিত্য করে দুজনের সংসার চালাতেন। 

    সাংবাদিক রবি বসু লিখছেন, “পরশপাথর ছবি রিলিজের সময় তুলসীদা কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। একদিন আমাকে বললেন, এইবারে আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাব। বড় বড় হোর্ডিংয়ে ইয়া বড় বড় মুখ আমার। জীবনে তো কখনও এত বড় বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। এর আগে যাও বা দু-চারবার হয়েছে, তা সে সব মুখ তো দূরবিন দিয়ে খুঁজে বার করতে হত। এ আমি কী হনু রে!”

    হাওড়ার ২নং কৈলাস বসু থার্ড লেনে দু’কামরার বাড়িতে থাকতেন স্বামী-স্ত্রী। সুযোগ পেলেই সেই ঘরে বসাতেন গানের আসর। একটি গান বিশেষ প্রিয় ছিল তাঁর—

    ‘শিবরাত্রির পরের দিন
    শিবের হল সর্দিকাশি
    ঘটি ঘটি জল ঢেলেছে
    জেঠি, কাকী, মামী, মাসি
    তাই শিবের হল সর্দিকাশি।
    আদা দিয়ে চা করে
    দুগ্গা এসে সামনে ধরে,
    ‘সিদ্ধি আজকে খেও না, বাপু’
    বললে শিবে মুচকি হাসি
    শিবের হল সর্দিকাশি।’

    তুলসীবাবু মারা যাওয়ার পর দু’মুঠোর জন্য দরজায় দরজায় ফিরেছেন উষারানী দেবী। সামান্য সঞ্চয় যা ফুরিয়ে গিয়েছিল অল্পদিনেই। বিক্রি করতে হয়েছিল তুলসী চক্রবর্তীর সমকটি মেডেলও।

    সত্যজিৎ তাঁকে বলতেন, ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র। ছবি বিশ্বাস নাকি একবার বলেছিলেন, তুলসী চক্রবর্তী বিদেশে জন্মালে অস্কার পেতেন। অস্কার অবিশ্যি পাননি ‘পরেশ দত্ত’। কিন্তু, বাংলা সিনেপাড়া পরশপাথরের ছোঁয়া পেয়েছিল অনেকবার। সেইসব ছোটো ছোটো ছোঁয়াতেই সোনা হয়ে থেকে গেছে কত সাদামাটা দৃশ্যও। আর, সেই ‘পরশপাথর’ তুলসী চক্রবর্তীও থেকে গেছেন টলিপাড়ার ‘মিথ’ হয়ে.। 

    ঋণস্বীকার : প্রতাপ দত্ত
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @