পোড়া শহরের চিত্রকর

গড়িয়াহাটের মোড়ে হঠাৎই সামান্য জটলা। রাসবিহারী-চেতলা বা হাজরা যাওয়ার অটো ধরতে ভিড় জমানো যাত্রীরাও দাঁড়িয়ে পড়েছেন ক্ষণিকের জন্য। একজন আঁকছেন রাস্তায়। যুবক, শ্যামলা। রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় গামছা পাগড়ির মতো প্যাঁচানো। সদ্য দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে ঘষটাতে থাকা শহরে উত্তাপ তখনো নামেনি। পিচের আসন প্রায় ফুটন্ত। সেই পিচ-রাস্তার ওপরেই দিব্বি বসে পড়েছেন মানুষটি। গরম উড়ে যায় ধোঁয়া ছাড়া বাসের মতো। গাল বেয়ে গড়িয়ে নামা ঘাম মুছে ফের রাস্তায় চক বোলান চিত্রকর। চিত্রকরই তো। গ্রীষ্ম-পোড়া শহরে ধুলোভরা পিচ-রাস্তাই তার ক্যানভাস।
আঁকার সরঞ্জাম বলতে নানা রঙের চক। হলুদ, সাদা, গোলাপি, নীল। এঁকেছেন মহাদেবকে। একপাশে ত্রিশূল, মাথার জটা এঁকেবেঁকে হয়ে গেছে নকশা। তার ওপরে দু’বার ইংরেজিতে লেখা ‘হেল্প মি’। দেখে শিবের মুখেই খুচরো কয়েন বা দশটাকার নোট ছড়িয়ে দেন কেউ কেউ। টাকা নিজের হাতে নেন না মানুষটি। কোত্থেকে এসেছেন, থাকেন কোথায়? জানতে চাইলে গুটিয়ে যান। উত্তর শোনাই যায় না। বোঝা যায় বাড়ি গড়িয়ায়। বিগত দশবছর ধরে রাস্তাজুড়ে আঁকাই তাঁর পেশা। কখনো আঁকেন এসপ্ল্যানেড মেট্রোর সামনের রাস্তায়। তারপর পরিযায়ী। এতে কাঙ্ক্ষিত আয় হয়? শুনে আরো কুণ্ঠিত হয়ে যান তিনি। না থাক, শিল্পীর কাছে এত প্রশ্ন রাখতে নেই।
যখন যা মনে হয়, তাই আঁকেন। মাথায় ঘুরতে থাকে নানা ফ্রেম, কখনো শিব, কখনো কার্টুনের চরিত্র... শুধু স্বপ্ন আর চিন্তাগুলো জড়িয়ে যায় মাঝেমাঝে। সমস্ত ছবিতেই সেই জড়িয়ে যাওয়া নকশাগুলো ফিরে ফিরে আসে। আঁকার জটিল সব তত্ত্ব তাঁর অজানা। নিজেকে শিল্পী ভাবতেও হয়তো কুণ্ঠা হয়। কাগজের ক্যানভাস ছোঁয়া হবে না এ-জন্মে। ধুলোয় ঢাকা গরম পিচের রাস্তাতেই এঁকে যেতে হবে ছবি। সেই ফ্রেমে কখনো ঢুকে আসবে ব্যস্ত পথচারীর পা। কেউ মাড়িয়ে দেবেন ছবিতে থাকা মেয়ের মুখের একাংশ। ফের সেইখানে চক বোলাবেন তিনি। লিখবেন সাহায্যের কথা। জটলা বেশি হলে আরো ছবির দিকে নেমে আসবে মুখ। ধুলো-ধোঁয়া-চিৎকার আর বদলে যাওয়া জটলার শহরে এই ছবিই তার আশ্রয়...
চিত্রকরের চিলেকোঠা নেই। রাস্তা রয়েছে...