চৌরঙ্গীতে নিখোঁজ এশিয়ার প্রাচীনতম হোটেল

১৮৬৭ সালের সবে শুরু। শীত বেশ ভালোই। বিদ্যাসাগর মহাশয় হন্যে হয়ে একটি বাড়ি খুঁজছেন। কিছুদিন আগেই উত্তরপাড়া থেকে ফেরার পথে ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি। চোট তখনও সারেনি। সেই অবস্থাতেই বাড়ি সন্ধান করে বেড়াচ্ছেন। প্রাসাদোপম না হলেও, সে বাড়িকে হতে হবে রুচিশীল। সুসজ্জিত। ইউরোপীয় জীবনযাত্রার সঙ্গে খানিক মানানসই। অবশেষে তেমন একটি বাড়ির হদিশ মিলল। কর্নওয়ালিস স্কোয়ারের ধারে, ২৩ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটে। চমৎকার সুন্দর সে বাড়ি। কিন্তু কার জন্য শারীরিক সব দুর্ভোগকে উপেক্ষা করে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি? সেই ব্যক্তি আর কেউ নন, স্বয়ং মধুসূদন দত্ত। বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরছেন মিস্টার ডাট। কিন্তু পরম বন্ধুর পছন্দ করা সেই বাড়িটি মিস্টার ডাট গ্রহণ করলেন না। ইউরোপের নেশা তখনো কাটাতে পারেননি তিনি। তাই দেশে ফেরা মাত্রই নিজের জন্য ঘর বুক করলেন বিলাসবহুল স্পেনসাস হোটেলে। স্পেনসাস হোটেল- যা ছিল ইউরোপীয় জীবনধারার এক অন্যতম নিদর্শন।
কলকাতার মধ্যে হয়তো চিরকালই থেকে যাবে একখণ্ড ইউরোপ। তা শুধু বাজার-অর্থনীতির কারণে নয়। এই শহর ইংরেজরা সাজিয়েছিল তাদের সমস্ত নিজস্বতা দিয়ে। তাদের হাত ধরে কলকাতায় ছায়া ফেলেছিল মধ্যযুগের লন্ডন। এসেছিল কেক পেস্ট্রির মিঠে ঘ্রাণ। কফিশপের তর্ক-আড্ডার পরিসর। বিয়ারের ধোঁয়াটে গন্ধ, আর হোটেলের লাগামহীন উল্লাস। বিলেত থেকে এসে বাড়ি না-পাওয়া অবধি কোথায় থাকবে ইউরোপীয় মানুষেরা? তাদের কথা ভেবেই কলকাতায় তৈরি হয়েছিল স্পেনসেস হোটেল।
১৮৩০সালে এই হোটেল তৈরি করেন মিস্টার স্পেনস নামের কোনো এক ব্যক্তি। তাঁর বিস্তৃত পরিচয় আজ মেলা কঠিন। স্পেনসেস হোটেলকে তিনি বানিয়েছিলেন চোখ ধাঁধানো জৌলুসে। বলা হয়, ভারতবর্ষ তো বটেই, গোটা এশিয়া মহাদেশেই নাকি এই হোটেল ছিল প্রথম ‘হোটেল’। প্রথম কিনা, তা নিয়ে ধন্ধ থাকলেও, স্পেনসেসের খ্যাতি ছিল আকাশছোঁয়া। তার প্রমাণ মেলে জুলে ভার্নের লেখায়। 'The Steam House'- বইতে তিনি উল্লেখ করছেন এই হোটেলটির কথা। যা প্রমাণ করে, খোদ ইউরোপেও পৌঁছেছিল এর খ্যাতি। গভর্নমেন্ট হাউজের ঠিক উত্তরে ছিল প্রাচীনতম এই হোটেল। ১৮৪১ সালে এই হোটেলের অ্যাটাচড বাথরুমসহ একটি রুমের ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা। অবশ্য একমাসের জন্য। অতিথি সংখ্যা বাড়লে ২০ টাকা করে মাথাপিছু অতিরিক্ত চার্জ। সেই যুগে মহার্ঘ বললে কম বলা হয়।
চৌরঙ্গী ও তার চারপাশের অঞ্চলটি ছিল ইংরেজদের অতি প্রিয় জায়গা। সেখানেই সার দিয়ে হোটেল, পানশালা, বিরাট বিরাট সব অট্টালিকা। যেমন লালবাজারে একদা ছিল লন্ডন ও হারমনিক পানশালা। ডেকার্স লেনে ছিল ম্যুরের পানশালা। আবার ছিল বেয়ার্ডের হোটেল। তবে এইসবের আগেই স্পেনসেস হোটেল জমিয়েছিল তার আসর। অপূর্ব সুন্দর ছিল নাকি এর গঠনশৈলী। এই হোটেলেই মহারাজা দলীপের সঙ্গে তাঁর মায়ের সাক্ষাৎ হয়েছিল।
আরো পড়ুন
ইতালিয়ান কলকাতার দিনগুলি রাতগুলি
প্রাচীন হোটেলগুলির খুব অল্প কয়েকটিই টিকে আছে। এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার গল্পে রয়েছে স্পেনসেসও। কোথায় ছিল সে ঠিক? প্রাচীন বইপত্র, ছবি জানাচ্ছে গভর্নমেন্ট হাউজের অতি নিকটেই। তবে দিক নিয়ে একটা জটিলতা আছে। ১৮৮০ সাল নাগাদ হোটেলের এই জায়গাটি সরকার নিয়ে নেয়। অনেকের মতে আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, এ-জি বেঙ্গলের বিশাল অট্টালিকা, সেটা নাকি ওই হোটেলটির অবশেষেই নির্মিত। তবে এই কথা সত্যিই মনে হয়, এ-জি বেঙ্গলের সুবিস্তৃত বাড়ি, তার নকশা, করিন্থিয়ান পিলার, লম্বা জানলা- এইসবের সঙ্গে প্রাচীনতম স্পেনসেসের সাদৃশ্য মেলেই। কেউ কেউ, পাথরের ফলকে লেখা দিকনির্দেশক দেখিয়েও প্রমাণ করেছেন, এ জি বেঙ্গলই স্পেনসেস হোটেল- কাউন্সিল স্ট্রিটের গায়ে লম্বা শরীর মেলে দাঁড়ানো, রাজভবনকেও যেন সে হার মানায়।
যাইহোক, এই হোটেল ও তার জীবনযাত্রা ঘিরে বাংলায় সিনেমা হয়েছে বেশকিছু। তাতে নাকি এই স্পেনসেস হোটেলটিই উঁকি দিয়েছে। যেমন ধরা যাক, শঙ্করের ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাস। সেখানেও আছে এই বুড়ো হোটেলের গপ্প। অনেক নামিদামি, অনেক এলোমেলো অগোছালো মানুষের জীবনকথা মিশে থাকে হোটেলের ঘরে। মাতাল কথোপকথন উড়তে থাকে, তার সঙ্গে মিশে থাকে যন্ত্রণাও। ইংল্যান্ড থেকে দূরে এই গ্রীষ্মপ্রধান কলকাতায়, প্রবাস জীবন কাটাতে কাটাতে ঠিক কতটা বেলাগাম যন্ত্রণায় দাহ হতে হয়েছিল কতজনকে, স্পেনসেস হোটেলের সঙ্গে সঙ্গে সেই ইতিহাসও আজ অনেকটাই নিখোঁজ, নিরুদ্দেশ।
তথ্যসূত্র: ‘আশার ছলনে ভুলি’, গোলাম মুরশিদ
‘কলকাতা একাল ও সেকাল’, রথীন মিত্র