No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মনসাপুজোয় দুই বাংলার শিকড় মেলায় ‘রয়ানি’ গান

    মনসাপুজোয় দুই বাংলার শিকড় মেলায় ‘রয়ানি’ গান

    Story image

    বাঁকে বাঁকে ডিঙ্গা পবনগতি যায়
    শালবনের রাজ্য গিয়া ততক্ষণে পায়।

    ‘আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে গ্রামবাংলা ভেলায় ভাসে।’ ভেলা আর ডিঙ্গার সেই কাল কি এক্কেবারে চলে গেছে বাংলা ছেড়ে? শ্রাবণ মাসের কয়েক পশলা বৃষ্টিতেই জল জমল কলকাতায়। খবইরে দেখাচ্ছে, বেহালায় বোট ভাসছে জমা জলে। এমনিতে এ-বছরটায় নাকি বৃষ্টির আকাল। গরমে শহরের প্রাণ ওষ্ঠাগত। অবশেষে দেরিতে বৃষ্টি এল। খানিক ভাসিয়েই এল। লোকে বলল, এ বর্ষা নয়, নিম্নচাপ। তাতেই ভেলা ভাসানোর জোগাড়। শহুরে প্রাণ বড়োই নাজুক। বেশি গরমও সয় না। বর্ষণও নয়। কাদামাখা ময়লা রাস্তা, তার ওপর জমা-জলে ডেঙ্গুর গুপ্ত ডেরা। সবমিলিয়ে জলের থেকে কেবলি ভয় ঘনিয়ে ওঠে। তবে এই ভয় তো আজকের নয়। কলকাতা যখন শহর হয়নি, তারও ঢের আগে থেকে বাংলার মানুষের জলজ-জীবন ডুকরে উঠত নানান ভয়ে। সেই ভয়েরই এক অন্যতম মাধ্যম ছিল সাপ। শ্রাবণ মাসের জলভরা দিনে আনাচকানাচ থেকে উঁকি দিত এই বালাই। তাকে তুষ্ট করতে চলত সর্পদেবী মনসার আরাধনা। 

    কলকাতায় সাপের উপদ্রব অবশ্য তেমন আহামরি নয়। এমনিতে বনবাদাড় কেটে সাফ। পুকুর বুজিয়ে তরতরিয়ে লম্বা হয়ে যায় ছাব্বিশ তলা ফ্ল্যাট। সাপের জায়গা ক্রমশ সংকুচিত। আর আশেপাশে কোথাও সাপ হানা দিলে কার্বলিক অ্যাসিড একটু উপুড় করে দাও। সাপ নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য, গান আছে। সাপের ছোবলে বিষজর্জর জীবনের মুমুক্ষু গান। 

    বরিশাল অঞ্চলে যে পালাগানের নাম রয়ানিগান, কলকাতার কলোনি অঞ্চল আজও শোনে সেই সুর- “সোনার বরণ লখাইরে আমার/ বরন হইল কালো / কিনা সাপে দংশিল তারে / তাই আমারে বলো...।” বিজয় গুপ্তর লেখা ‘পদ্মপুরাণ’ গীত হতে থাকে রয়ানি গানে। বেহুলার যন্ত্রণা, ভেলায় করে মৃত স্বামীকে নিয়ে নিরুদ্দেশ-যাত্রা, কালনাগিনীর বিষ থেকে স্বামীকে উদ্ধারের চেষ্টা- করুণ সুরে বিবৃত করে গায়নের দল। ইনিয়ে-বিনিয়ে ওঠা একঘেয়ে কান্নার সুরের মতোই এই রয়ানি গান। মূল গান যিনি করেন, তিনি সরকার। আর সঙ্গে ধুয়ো দেয় অন্যান্য গায়নেরা। মূলত নারীকণ্ঠই এই ধুয়োর গায়ন। বরিশাল নদীঘেঁষা দেশ। সাপের ভয় সেখানে আবহমান। আজও নাকি সে অঞ্চলের উজিরপুর ঝালকাঠি আগৈলঝাড়া বাকেরগঞ্জে শোনা যায় এই রয়ানিগান। হারমোনিয়াম, খোল, করতাল, সানাই নিয়ে গায়নের দল পরিবেশন করেন। কেউ বলেন রজনী থেকে ‘রয়ানি’, আবার কেউ বলেন রওনা হওয়া থেকে ‘রয়ানি’ শব্দের জন্ম। বরিশালের লোকজীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত শ্রাবণ মাসের এই গান।

    শ্রাবণ মাসেই স্বাধীন হয়েছিল দেশ। বরিশালে সেবার রয়ানি গান হয়েছিল কি? নাকি দেশভাগের দৌরাত্ম্যে এপার-ওপার ডিঙোতে গিয়ে বাদ চলে গিয়েছিল সেই বছরটা? জানা নেই। তবে সুদূর বরিশাল থেকে এপারে এলেন যারা, সঙ্গে নিয়ে এলেন এই গান। শ্রাবণ মাসের শেষপর্যায় জুড়ে অনেক বাড়িই ভেসে যায় রয়ানি গানে। বরিশাল-ঢাকা-নোয়াখালি-খুলনা তাতে মিলেমিশে যায়। আর শেষে এপারের আগল খুলে তা ঢুকে পড়ে কলকাতার অন্দরেও।

    সময় এগিয়ে চলে জলের স্রোতের মতোই। যেন বন্যার জল। এগোতে এগোতে কত কী যে সে খায়, আর কী যে রাখে-- তা হিসেব করা ভার। কলকাতারও তো কত কী বদলে গেল।

    আজ শ্রাবণ মাসের শেষ। কাল ভাদ্র। শহরের ‘কলোনি’ নামধারী অঞ্চলের অনেক বাড়িতেই মনসার পুজো। রয়ানি গানের সুর চড়ছে ক্রমশ। এপার-ওপারের ভাগ নেই তাতে। মঙ্গলকামনার সেই গানে ভাষার পার্থক্যও গুরুত্ব পায় না। পাড়ার মোড়ের দোতলা বাড়িটার শ্যাওলা-ধরা ছাদে তাই এপার-ওপারের সঙ্গে জড়ো হয়ে যান বেশকিছু বিহারি মহিলা। কোনো এক অদৃশ্য বা প্রায়-অসম্ভব বিপদ থেকে রক্ষা পেতে চলে দেবী মনসাকে তুষ্ট করার প্রক্রিয়া। কবেকার চাঁদ-বেহুলা-লখাই নতুন করে প্রাণ পায়। স্থানকালের হিসেব গুলিয়ে দিয়ে।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @