No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মোহনবাগানকে হারিয়ে মনোকষ্টে ভুগেছিলেন ‘কট্টর মোহনবাগানি’ গোলকিপার

    মোহনবাগানকে হারিয়ে মনোকষ্টে ভুগেছিলেন ‘কট্টর মোহনবাগানি’ গোলকিপার

    Story image

    সালটা ১৯৪০। ক্যালকাটা গ্রাউন্ডে আই এফ এ শিল্ড ফাইনাল। এরিয়ান্স বনাম মোহনবাগান। মোহনবাগানের ভরা টিম। কে দত্ত, পরিতোষ চক্রবর্তী, তারক চৌধুরী, প্রেমলাল, পারমানিক গুঁই, নির্মল মুখার্জি, অমিয় মুখার্জির মতো তারকারা আলো করে রয়েছেন দলে। ঐ তো, কেল্লার দিকের গোল থেকে থ্রু বল এল মোহনবাগানের নন্দ রায়চৌধুরীর পায়ে। হু হু করে উইং ধরে উঠে আসছেন রায়চৌধুরী। পেনাল্টিবক্স চিড়ে ঝড়ের মতো আক্রমণ ধেয়ে আসে। গোলে দাঁড়িয়ে তরুণ রাম ভট্টাচার্য। গ্যালারি ফেটে পড়েছে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায়। “গোওওও”... ভট্টাচার্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন পায়ে। সজোরে বুকে চার্জ খেয়েও প্রাণভোমরার মতো বলটাকে জাপ্টে ধরলেন তিনি।

    সে’বার এরিয়ান্স ক্লাবও অবশ্য শিল্ড জেতবার দাবিদার। এরিয়ান্সের হয়ে খেলছেন, ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও কিংবদন্তি কোচ স্যার দুঃখিরাম মজুমদারের ভাইপো অলরাউন্ডার ‘ছোনে’ (সন্তোষ) মজুমদার। এছাড়াও নাসিম, অজিত গড়গড়ি, দাশু মিত্র, নীরেশ মজুমদার, অমল ভৌমিক, অচ্যুৎ মুখার্জি-- কে নেই ! এরিয়ান্স প্রায় বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের গোলে। চার-চারটে গোল দিয়ে মোহনবাগানকে ল্যাজেগোবরে করে প্রথমবার আইএফএ শিল্ড ঘরে তোলে তাঁরা। সারা ম্যাচে গোলকিপার শ্রীভট্টাচার্য একবার মাত্র ‘বিট’ হন। এত বড়ো ব্যবধানে জয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও এরিয়ান্স সমর্থকদের চোখে তিনিই ছিলেন গল্পের নায়ক। 

    রাম ভট্টাচার্য। তিরিশ থেকে চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি, গড়ের মাঠ কাঁপানো এক ফুটবলার। বাগবাজারের তৃতীয় ডিভিশন থেকে মোহনবাগানের বি-টিম। প্রেসিডেন্সি কলেজের ডাকসাইটে ফার্স্ট টিমের গোলরক্ষক। যেখানে খেলতেন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় , নির্মল চ্যাটার্জি, আব্বাস নাসিম, দ্রুবদাসের মতো খেলোয়াড়রা। কলেজের প্রায় সমস্ত ট্রফি জিতেছিল সেই টিম। ‘ইলিয়ট শিল্ড’-ও তাঁদের দখলে। ১৯৩৬ সালে বাগবাজারের ‘নেবুবাগান’ থেকে মোহনবাগান বি টিম। দুর্ভাগ্যবশত, সেখানে ইস্টবেঙ্গল থেকে দল বদলে চলে আসেন কিংবদন্তি গোলকিপার কে দত্ত। ফলে, অসামান্য ট্র্যাক রেকর্ড সত্ত্বেও ১৯৩৯ সালে ট্রান্সফার নিতে হয় রাম ভট্টাচার্যকে। তারপর, ১৯৪০-এ এরিয়ান্স-এর হয়ে রেঞ্জার্সকে এক গোলে হারিয়ে ফাইনালে। বাকিটা ইতিহাস।

    আজীবন বাগবাজারে বড়ো হয়ে ওঠা রামবাবু ছিলেন কট্টর মোহনবাগানি। তাই প্রিয় ক্লাবের হয়ে শিল্ড না জিততে পারার দুঃখের কথা লিখে গিয়েছেন তাঁর স্মৃতিকথা—‘দুটি নয়ন মেলে’ বইতে। বইটি সম্ভবত আজকের বাজারে আউট অফ প্রিন্ট। 

    পিতৃবিয়োগের পর ছাড়তে হয় খেলা। আর পাঁচটা বেকার যুবকের মতো ঘুরেছেন চাকরির সন্ধানে। বাবা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসক ডাক্তার পশুপতি ভট্টাচার্য। শোনা যায়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রামবাবুর হয়ে চাকরির দরখাস্ত করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। খেলার সুবাদে খুব কাছ থেকে দেখেছেন গোষ্ঠ পালকে, আব্দুস সামাদকে। তাঁর জবানবন্দীতে, ‘চাইনিজ ওয়াল’ গোষ্ঠ পাল বিখ্যাত ছিলেন ভয়ঙ্কর সহনশীলতার কারণে। ‘ব্লু রিবন্ড বনাম ইস্ট ইয়র্ক’ ম্যাচে গোষ্ঠবাবুর খালি পায়ের শট লেগে বুটপরা সাহেব প্রায় টসকে গিয়েছিল। ‘গুরু’কে পরে প্রণাম করাতে তিনি আপত্তি করেন, “বামুনের পোলা হইয়া পায়ে হাত দিবি ক্যান?” ভট্টাচার্য বামুনের সন্তান রাম অবশ্য সে বারণ মানেননি।

    আর ফুটবলের জাদুকর, আব্দুস সামাদ ছিলেন তাঁর কাছে ‘সামাদ চাচা’। দেশভাগের পর চলে যান ওপার বাংলায়। ঘটনাচক্রে ট্রেনের কামরায় রামবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ‘চাচা’র। মাঠের বাইরে গোঁড়ামি থাকুক, খেলোয়াড়ের তো জাত-ধর্ম হয় না!

    খেলোয়াড় আর মাঠ। তিন-কাঠির নিচে দাঁড়িয়ে গোলকিপার। গঙ্গার হাওয়ায় গ্রাস কাটিং শট বাঁক খেয়ে ঢুকছে গোলে। হঠাৎ মুঠির আঘাতে, কিংবা দু’হাতের গ্রিপে সেই বলকে বিরত করলেই নিভে যেতে পারে বিপক্ষ দলের আশা। শেষ প্রহরীটি দাঁড়িয়েছিল জীবনের সমস্ত আক্রমণ ঠেকাবে বলে। পেরে উঠল কি? রামবাবুকেও তাই গোলকিপিং ছেড়ে হয়ে উঠতে হয় চাকুরে। বাঙালির ফুটবলচর্চা থেকে বাগবাজারের গলির অন্ধকারে কি এভাবেই হারিয়ে গেলেন এরিয়ান্স এর  গোলকিপার ?

    Tags:

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @