বাল্যবিবাহ-র বিরুদ্ধেও লড়ছে পুরুলিয়ার ‘প্যাডগার্ল’ কিরণ

একডাকে সবাই তাকে চেনে ‘প্যাডগার্ল’ নামে। পুরুলিয়া মফস্সল থানার হুটমুড়া হরিমতী উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা মেয়েটিকে বড়ো সহজে নিজেদের সব সমস্যার কথা খুলে বলতে পারে তার সমবয়সী বা বয়সে ছোটো মেয়েরা, এমনকি বয়সে বড়ো কাকিমা-জেঠিমারাও। তার হাত ধরেই যে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার শিখছেন হুটমুড়া, জয়নগর, কড়চা, ভাংরা, সিদপুর গ্রামের মহিলারা। শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার শেখানোই নয়, মেয়েটি লড়াই করতে শুরু করেছে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও। লড়াই করতে শেখাচ্ছে অন্যদেরও। নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্নও দেখাচ্ছে পুরুলিয়ার গ্রাম-গ্রামান্তরের মেয়েদের। আর, এহেন কিশোরীকে ঘিরেই আজ স্বপ্ন দেখছে পুরুলিয়াও।
মেয়েটির নাম কিরণ বাউড়ি। হুটমুড়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গেঙ্গারা গ্রামে তার বাড়ি। বাবা চণ্ডীচরণ বাউড়ি সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ। চারপাশে অনেক মেয়েকেই বাল্যবয়সে বিয়ে করতে দেখতে দেখতেই বড়ো হওয়া কিরণের। সেই ছোটো থেকেই মেয়েদের ওপর নির্যাতন, নারী-পুরুষ বৈষম্য তাকে বেশ নাড়িয়ে দিত ভিতর থেকে। একটা জেদ যেন তখনই ঢুকে গিয়েছিল তার মাথায়।
হুটমুড়া হরিমতী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের থেকেই প্রথমে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিষয়টি জানতে পারে কিরণ। তারপর নিজের উদ্যোগেই শুরু করে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ। কিরণের নিজের গ্রাম হুটমুড়া ছাড়াও আশপাশের গ্রামের প্রায় সমস্ত মহিলাই ঋতুচক্রের সময় ব্যবহার করতেন কাপড়। তা থেকে ইনফেকশনও ছড়াত। কিরণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে বোঝাতে শুরু করে স্যানিটার ন্যাপকিন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা। কীভাবে এই ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হয়, সেটাও হাতেকলমে শিখিয়ে দিত সে। স্কুলের অন্যান্য ছাত্রীদের মধ্যেও সে এই সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে। ধীরে ধীরে সবার কাছেই জনপ্রিয় ও আপন হয়ে ওঠে কিরণ। কোনো ছাত্রীর কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার টাকা না থাকলে নিজের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তাদের ন্যাপকিন কিনে দিত সে।
কিরণের এই উদ্যোগের খবর পৌঁছায় পুরুলিয়ার প্রাক্তন জেলাশাসক অলকেশ প্রসাদ রায়ের কানেও। তখন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুরুলিয়ার কিশোরী-যুবতীদের স্বাস্থ্য-সচেতন করার জন্য ‘উড়ান’ নামের একটি প্রকল্প শুরু হয়েছিল। সেই প্রকল্পের মুখ হয়ে ওঠে কিরণ। সরকারি সাহায্য পাওয়ার পর তার কাজ আরো গতি পায়। কিছুদিনের মধ্যেই ‘ইউনিসেফ’ এবং পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’-এর সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠে সে। বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার শেখানোই শুধু নয়, সেই ন্যাপকিন ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সেই বিষয়েও কড়া নজর তার।
আরো পড়ুন
“‘ইতি’ বীরহলি গ্রামের এক দামাল মেয়ে
এরই পাশাপাশি কিরণ যুক্ত হয়েছে বাল্যবিবাহ রোধের যুদ্ধেও। বাল্যবিবাহ বন্ধ করা নিয়ে একাধিক কর্মসূচিতে সে এগিয়ে এসেছে একদম সামনের সারিতে। কন্যাসন্তানকে কেন এত অপমান, অবহেলা সহ্য করতে হবে—এ তার চিরকালীন প্রশ্ন। এতকিছুর মধ্যেও সে কিন্তু পড়া থামায়নি। কিরণ উকিল হতে চায়। চায় উকিল হয়ে আইনি যুদ্ধে পুরুলিয়া-সহ আরো বড়ো দুনিয়ার বহু মেয়ের পাশে দাঁড়াতে। আর উকিল হতে গেলে তো পড়াশোনায় মনোযোগী হতেই হবে।
পুরুলিয়ারই ভূমিসন্তান বাঘমুণ্ডির যুবক অক্ষয় ভগতও বাল্যবিবাহ রোধের জন্য প্রচার করতে বেরিয়ে পড়েছিল সাইকেলে। সারা ভারত সাইকেলে ঘুরে, গিনেস বুকে নাম তুলে সে ফিরেছে পুরুলিয়ায়। চালিয়ে যাচ্ছে বাল্যবিবাহ আটকানোর প্রচার। একই জেলার আরেকজন মেয়ে কিরণও তার পথ ধরেই চলেছে। অবশ্য সাইকেল-ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে প্রচার নয়, তার পন্থা আলাদা। কিন্তু একদিন এইসব চেষ্টা জড়ো করেই সুদিন আসবে, জানে পুরুলিয়ার সংবেদনশীল মানুষ। কিরণকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন যে তাদের।
ছবিসূত্র: ইউনিসেফ
(‘Kiran, a girl from Purulia, who fights child marriage’ থেকে।)