নকু ধর, রাজা সুখময় ও পোস্তা রাজবাড়ি-- কলকাতার এক আদিম রাজকাহিনি

জগৎ শেঠদের জগৎ-জোড়া খ্যাতি। কিন্তু তাঁরা ছাড়াও আরো কিছু মানুষ ছিলেন প্রাচীন কলকাতায়। মানে গ্রামীণ কলকাতায়। নামে জগৎশেঠ তাঁরা নন ঠিকই। কিন্তু অবস্থায় প্রায় তার সমতুল। সে গল্প সুবিশাল। এর শুরুটা করা যাক শেষ থেকে।
আরো পড়ুন
প্রথম বাঙালি কোটিপতির গল্প
উত্তর কলকাতার এক বড়ো রাস্তা। রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট। রাজাবাজার খালপাড় থেকে মানিকতলা ছুঁয়ে, শ্যামবাজার অবধি তার বহমানতা। এই রাস্তা ধরেই সহজে পৌঁছে যাওয়া যায় বড়োবাজারের পোস্তা রাজবাড়ির দোরগোড়ায়। তবে পিচের রাজপথ ধরে নয়। এই যাত্রা আসলে এক সুদীর্ঘ ইতিহাসের। কলকাতা শহরের বেড়ে ওঠার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সেও।
উনিশ শতকে কলকাতার পথঘাট তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রাজা দীনেন্দ্রনারায়ণের। কলকাতা কর্পোরেশনকে তিনি দান করেছিলেন মোট তিন প্রস্ত জমি। জোড়াসাঁকো ও শিকদার পাড়ায় ছড়িয়ে আছে সেগুলো। তখনও অবশ্য ‘রাজা’ উপাধি লাভ হয়নি তাঁর। প্রচুর দানধ্যান করে ১৮৯৩ সালে প্রথমে পেলেন ‘কুমার’ উপাধি। তারপর ১৯১৫ সালে ‘রাজা’।
জোড়াসাঁকো রাজবাড়ি
‘রাজা’ উপাধিটির প্রতি গোপন বা প্রকাশ্য অনুরাগ সে যুগের বহু মানুষেরই ছিল। তা রাজকীয় বৈভব ও তার উজ্জাপনের প্রতি টান থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রাজা হতে গেলে শুধু তো সম্পদ থাকলে চলে না। বা সঞ্চয়ী হলেও চলে না। রাজাকে দান করতে হয়। সুপ্রচুর দানেও যাঁর সম্পদ হ্রাস পায় না- সেই তো রাজা হওয়ার যোগ্য। রাজার তো হারাবার ভয় নেই। আঠেরো-উনিশ শতকে বহু মানুষই ‘রাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন এই দানধ্যানের মহিমার জন্য। দীনেন্দ্রনারায়ণও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর বেড়ে ওঠাও ছিল সেই মহলেই।
দীনেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন রাজা সুখময়ের উত্তরপুরুষ। সুখময় রায় বাহাদুরের পুত্র রামচন্দ্র। তাঁর প্রপৌত্র দীনেন্দ্রনারায়ণ। রাজা সুখময়ের পুত্রদের আমলের পরে রাজভাঁড়ারে টান পড়তে থাকে। আবার তা রাজকীয় হয়ে ওঠে দীনেন্দ্রনারায়ণের সময়ে।
আরো পড়ুন
বেলভিডিয়ার এস্টেট ও আলিপুরের ভূত
কে এই রাজা সুখময়? রাজা সুখময়ের আমল থেকেই পোস্তা রাজবাড়ির জমজমাটি আমলের শুরুয়াত। আজও সেই বাড়ি বড়োবাজারে দাঁড়িয়ে। যদিও স্বাধীনতা পরবর্তীতে কলকাতাকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে পোস্তা রাজবাড়ির কিছু অংশ ভাঙতে হয়। রাজা সুখময় ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এলিজা ইম্পের দেওয়ান। তাঁর কলমেই লেখা হয়েছিল রাজা নন্দকুমারের ফাঁসির হুকুম। উলুবেড়িয়া থেকে পুরী পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ তাঁরই কৃতিত্ব। যাতে জগন্নাথ মন্দিরে নির্বিঘ্নে পৌঁছানো যায়, সে কারণেই এই ব্যবস্থা। লম্বায় সে রাস্তা ২৮০ মাইল। শুধু রাস্তাই নয়। রাস্তার ওপর ধর্মশালা, সেখানে প্রায় ৫০০ জন তীর্থযাত্রীর থাকার বন্দোবস্ত। এছাড়া দু-মাইল, চার-মাইল অন্তর কূপ-- সবই করেছিলেন রাজা সুখময়।
আরো পড়ুন
সিংহদুয়ার এবং আরেকটি মস্ত বাড়ির গল্প
পোস্তা রাজবাড়ি যেমন রাজা সুখময়ের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে, তেমনি কলকাতার নানান জায়গায় মিলবে তাঁর পাঁচ সন্তানের নানান স্মৃতিচিহ্ন। জোড়াসাঁকো রাজবাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বড়ো ছেলে রামচন্দ্র রায়ের স্মৃতিবহন করে। সেজো ছেলে বৈদ্যনাথ রায়। আজকের চিড়িয়ামোড়ে ছিল তাঁর বাড়ি। শুধু বাড়ি নয়। পাঁচশ বিঘে জমির ওপর ছিল তৈরি কিছু পশুপাখির বাসস্থান। সেই থেকেই নাম চিড়িয়ামোড়।
সুখময় ‘রায় বাহাদুর’ হওয়ার আগে ছিলেন সুখময় পাল। পিতা রঘুনাথ পাল, মা- পার্বতী। রঘুনাথ পাল ছিলেন ঘরজামাই। শ্বশুর ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। এমনই তাঁর প্রতাপ যে কলকাতাবাসী মুখে মুখে ছড়া কাটত তাঁর নামে-
“গোবিন্দরামের ছড়ি
উমিচাঁদের দাড়ি
নকু ধরের কড়ি
মথুর সেনের বাড়ি।”
শ্রীযুক্ত নকু ধরের নাতিই হলেন সুখময় পাল। নকু ধর বা লক্ষ্মীকান্ত ধরের আমলে ইংরেজ সবেমাত্র গুটিগুটি পায়ে জাল ফেলছে কলকাতার চৌহদ্দিতে। শহর তখন ঢের দূরের গল্প। পলাশির যুদ্ধও তখন হয়নি। নকু ধর ছিলেন লর্ড ক্লাইভের দেওয়ান। মা লক্ষ্মীর কৃপায় ধনলক্ষ্মী উপচে পড়ত তাঁর সংসারে। তাই দানও করতেন দুহাতে। ইংরেজদের যখনি টাকার দরকার, তখনি হাত পেতেছে নকু ধরের কাছে। হেস্টিংস যুদ্ধ করবে মারাঠাদের সঙ্গে- টাকা দিয়ে সাহায্যকারী নকু ধর। একটু-আধটু নয়। নব্বই লক্ষ টাকার তোড়া এসেছিল সাহায্য হিসেবে। এমনকি রাজা নবকৃষ্ণ দেবের ‘রাজা’ হয়ে ওঠার পেছনেও এই নকু ধরই। তিনিই জুটিয়ে দিয়েছিলেন মুন্সির চাকরি।
নকু ধরের আদি নিবাস ছিল সপ্তগ্রাম। কিন্তু কলকাতার সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল বেশি। নকু ধরকে ‘রাজা’ উপাধি দিতে চেয়েছিল ইংরেজ। কিন্তু তিনি নিতে রাজি হননি। সে উপাধি তুলে রাখতে বলেছিলেন নাতির জন্যে। কেন? হয়তো এটাও ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’র চিরন্তন গল্প।
কলকাতা শহর গড়ার অন্যতম কারিগর নকু ধর ও তাঁর উত্তরপুরুষরা। কিন্তু আজ তারা ভুলে-যাওয়া এক অধ্যায়। অথচ এই শহরের ইতিকথা লিখতে বসলে ইংরেজদের থেকে এদেশীয় মানুষদের অবদানই চোখে পড়ে বেশি।