মানবেন্দ্র অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের বললেন, শ্যামল, সতীনাথ, নির্মলেন্দুকেও নিতে হবে

তখন রেকর্ড কোম্পানি, রেকর্ড করা গানের স্যাম্পেল কপি দিত শিল্পীদের। শিল্পী সবুজ সংকেত দিলে সেটা প্রিন্ট হয়ে বেরোবে। সে বছর, খুব ভুল না করলে ১৯৫৭, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় আর একজন শিল্পী গেছেন উৎপলা সেনের কাছে স্যাম্পেল রেকর্ড নিয়ে। কার গান হিট হবে জানতে। দুজনই পরস্পরের সুরে গেয়েছেন সে’বছর। সব কিছু শুনে-টুনে উৎপলা সেন বললেন, দুজনের সুরই অনবদ্য হয়েছে, তবে সতীনাথের সুর দেওয়া গান দুটো হিট হবেই। উৎপলা সেনের সামনে দুই বন্ধু পরস্পরের কাছে বাজি রাখলেন, HMV প্রথম ছ’মাসের বিক্রির যে লিস্ট দেবে, তাতে যার গানের বিক্রি বেশি হবে, সেই জয়ী। ঐ শিল্পী যদি বাজি জেতেন তাহলে সতীনাথ ওঁকে এক কার্টন বিয়ার দেবেন, আর উনি হারলে সতীনাথকে দেবেন এক কার্টন গোল্ড ফ্লেক। সে বছর দেখা গেল, বেস্ট সেলার হিসেবে জ্বলজ্বল করছে শ্যামল মিত্রের গান, সতীনাথেরই সুর করা- “এত আলো আর এত হাসি গান” আর অন্য দিকে “তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর।” আর, শ্যামল মিত্রের সুর করা সতীনাথের গান, “রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ভরে” এবং “পথ চেয়ে শুধু মোর দিন কেটে যায়”-ও সুপারহিট।
আরো পড়ুন
সুরের দম্পতি সতীনাথ- উৎপলা
একবার মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নতুন গাড়ি দেখে শ্যামল মিত্র বললেন, তাঁরও একটা চাই। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সেই মডেলের গাড়ি শ্যামলকে এনে দিলেন। একই গাড়ি সতীনাথ মুখার্জি নির্মলেন্দু চৌধুরী অবধি পৌঁছে গেল। এবার পালা চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের। এক মডেলের গাড়ি আর কত পাওয়া যাবে! চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে রাগাবার জন্যে শ্যামল বললেন, আমরা সব আধুনিক গানের শিল্পী, লোকসংগীতের শিল্পী আমাদের জন্য একরকম গাড়ি, তুই হলি গিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী, তোকে আলাদা গাড়ি জোগাড় করে দিচ্ছি। চিন্ময় যা বোঝার বুঝলেন। গাড়িটা ছিল– মরিস মাইনর। চিন্ময় মারা যাবার পর ‘বান্টি’ সিনেমার সামনে গাড়িটা পার্ক করা থাকত।
মানবেন্দ্র ছিলেন হুল্লোড়বাজ মানুষ। ডায়মন্ডহারবারে অনুষ্ঠান হবে, উদ্যোক্তা এসেছেন ওঁর কাছে। মানবেন্দ্র বললেন, নিলে আমাদের চারজনকে নিতে হবে। চারজন, অর্থাৎ মানব, শ্যামল, সতীনাথ এবং নির্মলেন্দু। আর চারজনের চারটে অস্টিন গাড়ি যাবে। চারজনের সঙ্গে একজনই গেলেন তবলা নিয়ে, তিনি রাধাকান্ত নন্দী। অনুষ্ঠান থেকে পাওয়া টাকা সমান পাঁচভাগে ভাগ হল।
অমিয় দাশগুপ্তের লেখা একটা গান অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সুর করে HMV-তে নিয়ে গেছেন। মাথায় ঘুরছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম। HMV–এর তৎকালীন কর্তা গীতিকার পবিত্র মিত্র বললেন, “বুঝেছি গানটা হেমন্তবাবুকে মাথায় রেখে করছেন। গানটা শ্যামলকে দিন, দেখুন কী হয়।” সে গান শেষ অবধি শ্যামল রেকর্ড করলেন। “হংস পাখা দিয়ে নামটি তোমার লিখি”— ফলাফল কী যে হল, সেটা শ্রোতা নিশ্চয়ই জানেন। শ্যামল মিত্র মনে করতেন, আধুনিক গানের মুখড়া যদি আকর্ষণীয় না হয়, তাহলে শ্রোতা সেই গান নেবে না। পাঠক, খেয়াল করে দেখুন ওঁর গানের মুখড়াগুলো। “দোলে শাল পিয়ালের বন”, “হয়তো কিছুই নাহি পাব”, “এ প্রেম যেন তোমার স্বপন কোনো কবির”-- এই তিনটে গানের সুরকার শ্যামল মিত্র। এই গানগুলোর মুখড়া শুনে দেখলেই শ্যামল মিত্রের কথা কতখানি যথার্থ, সেটা স্পষ্ট হবে। শুধু তাই নয়, এঁদের সবার গানের আসল আকর্ষণের জায়গা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুখড়া আর সঞ্চারী। হিমাংশু দত্ত থেকে হেমন্ত সমস্ত সফল সুরকারের অধিকাংশের এটাই প্লাস পয়েন্ট।
আরো পড়ুন
তুমি সতীনাথ নও, শিউনাথ
শক্তি সামন্তের বাড়িতে শ্যামল সুর করা গান শোনাচ্ছেন ‘অমানুষ’সিনেমার জন্য, পাশে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। একটা গানও শক্তি বাবুর পছন্দ হচ্ছে না দেখে গৌরীপ্রসন্ন কাছেই রাহুল দেব বর্মনের বাড়ি চলে গেলেন। এদিকে শ্যামল তখন বাথরুমে গেছেন, সেই সময় ওঁর ভাই সলিল মিত্র ঘরে ঢুকে বললেন, দাদার সুরে গৌরীবাবুর লেখা পুরনো একটা গান শোনাতে চান। শক্তি সামন্ত সেই গান শুনে খুশি হলেন। বাথরুম থেকে ফিরে শ্যামল শুনলেন ভাইয়ের কীর্তি, সঙ্গে জানলেন পরিচালকের গানটা পছন্দ হয়েছে। গৌরীবাবুকেও ডাকা হল। সামান্য এডিট করে গানটা ফের লিখে দিলেন তিনি।
এদিকে বিপত্তি বাঁধল কিশোরকুমারকে নিয়ে। প্রথমে গান পছন্দ হওয়ায় রেকর্ড করবেন বলেছিলেন। কিন্তু রুমা গুহঠাকুরতা বললেন ওঁকে, এটা শ্যামলেরই হিট একটা গান, রেডিয়োতে গাওয়া। শুনেই কিশোর বেঁকে বসলেন। রুমা দেবী সত্যিটাই জানিয়েছেন। এদিকে, শ্যামল মিত্র কিশোরকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন-- এটা সিনেমার গান নয়, রেকর্ডও হয়নি, রেডিওতে গাওয়া হয়েছে মাত্র। অনেক চেষ্টার পর কিশোরকে রাজি করিয়ে শ্যামল রেকর্ড করালেন, “কী আশায় বাঁধি খেলা ঘর”। মজার ব্যাপার, গানটা গেয়ে কিশোর জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন।