শক্তিগড়ে গাওয়া ঘি-তে তৈরি ল্যাংচার একমাত্র ঠিকানা

ল্যাংচার নাম ল্যাংচা কেন, তা নিয়ে ‘রূপমঞ্জরী’ উপন্যাসে একটা খাসা গল্প বলেছিলেন নারায়ণ সান্যাল। সেই গল্পে ছিল বর্ধমান রাজপরিবারের একজন পুত্রবধূ আর একজন খোঁড়া ময়রা। ঘরের লক্ষ্মী বৌটি একবার মিষ্টি খেয়েছিল বটে। বর্ধমানে নয়, নদীয়ায়, বাপের বাড়ি থাকাকালীন। মিষ্টিটা দেখতে ভালো নয়, কালোপানা লম্বাটে। কিন্তু কী স্বাদ! আহা, মুখে লেগে আছে। কিন্তু মিষ্টির নাম মনে নেই। এদিকে সে তখন সন্তানসম্ভবা। “কী খেতে ভালো লাগে বৌমা?” প্রশ্নের উত্তরে শাশুড়িকে সে মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, ‘ল্যাংচা’। এ আবার কেমন মিষ্টি! সবাই অবাক। কিছুক্ষণ পরে বর্ধমানরাজ জানতে পারেন, মিষ্টির নাম আদপে সেটা নয়। ল্যাংচা মানে সেই খোঁড়া ময়রা। তাঁর বানানো মিষ্টির নাম বলতে না পেরে সেই ময়রার কথাই বলে ফেলেছে পুত্রবধূ।
অতএব, নদীয়া থেকে ডাক পড়ল সেই ময়রার। রাজা তাঁকে জমিজমা দান করলেন বর্ধমানের পুবে চারক্রোশ দূরে বড়শূল গ্রামে। তাঁর সেই মিষ্টি খেয়ে সবাই মুগ্ধ। নাম ছড়িয়ে পড়ল ময়রার। বড়শূল থেকে আধক্রোশ দূরে শক্তিগড় গ্রামে তিনি নিজের দোকানও দিলেন। আর তাঁর ভিয়েন থেকে রোজ একমণ করে মিষ্টি যেতে লাগল বর্ধমান রাজবাড়িতে। মিষ্টির নাম কী? একটা পুরোনো নাম ছিল বোধহয়, কিন্তু ততদিনে পুত্রবধূর মুখ ফসকে বলে ফেলা নামটাই হয়ে গেছে আসল নাম-- ‘ল্যাংচা’।
এই গল্পে কতখানি মিষ্টি রস মিশিয়েছেন নারায়ণ সান্যাল তা জানা নেই। তবে, ল্যাংচার নামের মতোই ল্যাংচার দোকানের নাম নিয়েও রীতিমতো গবেষণা করা যেতে পারে এখন। সেদিনের সেই শক্তিগড় গ্রাম আজ ল্যাংচার দোকানে রমরম করছে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে বা ২ নং জাতীয় সড়ক ধরে শক্তিগড় ঢুকতেই রাস্তার দু’পাশে সারি সারি মিষ্টির দোকান। সব দোকানের নামেই ‘ল্যাংচা’ হাজির। ‘ল্যাংচা নিকেতন’, ‘ল্যাংচা কুঠি’, ‘অ্যারোমা স্পেশাল ল্যাংচা’, ‘ল্যাংচা স্টেশন’, ‘ল্যাংচা প্লাজা’, ‘ল্যাংচা হাট’, ‘কৌশিক ঘোষের ল্যাংচা’ ও আরো অষ্টোত্তর শতনাম সব দোকানের। একবার গিয়ে পড়লে রীতিমতো থই না পাওয়ার জোগাড় হবে। নামের এমনই মহিমা!
আর, এইসব নামের ভিড়েই আটপৌরে, ছিমছাম আদল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি দোকান। এটিও মিষ্টিরই দোকান, এর নামেও ‘ল্যাংচা’ মিশে। কিন্তু নামটি বেশ অন্যরকম— ‘ল্যাংচাপণ’। চারপাশে এত ল্যাংচার বাহার, প্রথম দর্শনে নামটি খটমট ঠেকতে পারে। কিন্তু, আলাদা করে চোখেও পড়বে। দোকানে ঢোকার মুখেই ওপরের চাতালে অদ্ভুত ক্যালিগ্রাফিতে নামটা লেখা। অনেকটা মাছের মতো দেখতে যেন। অবশ্য, কেউ চাইলে শঙ্খও ভাবতে পারেন। আর, এইসব দেখতে দেখতেই মনে পড়ে যাবে ‘আপণ’ মানে দোকান। তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘ল্যাংচা’ শব্দকে। আবার, ল্যাংচা খাওয়ারই পণ অর্থেও পড়া যায় এই নাম। আলঙ্কারিকেরা দেখলে হয়তো বলতেন অভঙ্গ শ্লেষ।
শুধু নাম নয়, চোখে পড়বে আর একটা বাক্যও। দোকানের সাইনবোর্ডের ওপরে লেখা। ‘বিঃ দ্রঃ- একমাত্র এই দোকানেই গাওয়া ঘিয়ের ল্যাংচা পাওয়া যায়’। এবার আগ্রহটা ঘন হবে। ঢুকেই পড়বেন হয়তো দোকানে। সীতাভোগ, মিহিদানা, ল্যাংচা তো আছেই, দোকানি আপনাকে অনুরোধ করবেন কচুরি-আলুর তরকারিও চেখে দেখার জন্যে। আপনি রাজি হতেই এসে পড়বে প্রমাণ সাইজের ফুলকো কচুরি। সেই স্বাদের প্রেমে না পড়ে উপায় নেই।
এরপর ল্যাংচা চাখার পালা। বিষ্ণুপুর থেকে খাঁটি গাওয়া ঘি এনে তাতে ভাজা হয় এই দোকানের ল্যাংচা। বিষ্ণুপুর ছাড়া অন্য কোনো অঞ্চলের ঘি ব্যবহার করা হয় না ভুলেও। ল্যাংচার ‘কোয়ালিটি’ নিয়ে এমনই খুঁতখুঁতে এই দোকানের মালিকপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সত্যিই নাকি শক্তিগড়ের অন্য কোনো দোকানে ল্যাংচার এমন বিশেষত্ব নেই। ল্যাংচার আকার নিয়ে নানা প্রতিযোগিতা আছে, স্বাদ নিয়ে নানা দাবি-বড়াই আছে। কিন্তু গাওয়া ঘিয়ের প্রতি এমন পক্ষপাত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিগত ১৪ বছর ধরে এটাই এই দোকানের এইউএসপি। অন্যান্য দোকানের চাইতে বরং এই দোকানের ছোটো আকারের ল্যাংচার চাহিদা বেশি। কারণ, অনেকের মতে ছোটো ল্যাংচাতেই ঘিয়ের স্বাদটা বেশি খোলতাই হয়। অবশ্য খরিদ্দারদের এই দাবি বিনীত হেসে নাকচ করবেন দোকানি। বলবেন, বড়ো ও ছোটো—দুই জাতেই ঘিয়ের স্বাদ সমান মিলবে। আপনি অবশ্য না-ই মানতে পারেন সেই কথা।
কিন্তু, শক্তিগড়ের অন্যান্য দোকানের তুলনায় ‘ল্যাংচাপণ’-এর ল্যাংচা যে সত্যিই আলাদা, তা আপনাকে মানতেই হবে। দেখনদারি নেই, বিপুল বিজ্ঞাপন নেই—শুধু স্বাদের এই নিজস্বতার ওপর ভিত্তি করেই বেঁচে আছে এই দোকান। বলা ভালো, রমরম করে চলছে। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই দেখা গেল কলকাতা থেকে ঘণ্টা দুই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন একজন। শুধু ‘ল্যাংচাপণ’ থেকে ল্যাংচা নিয়ে যাবেন বলে। বাইরে থেকে বন্ধু এসেছে, তাকে এই দোকানের ল্যাংচা খাওয়াবেন পণ করেই চলে এসেছেন এতটা দূর। বলছিলেন, এইটা তার নিজের দোকান হয়ে উঠেছে বিগত কয়েক বছরে।
শুনে হঠাৎ মনে হল, ‘ল্যাংচাপণ’ নামটি সার্থক। ‘পণ’ আর ‘আপণ’ অর্থে তো বটেই, এমনকি ‘আপন’ অর্থেও। বানানের যে-টুকু ভেদ ল্যাংচার স্বাদের কাছে তা আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। ঘিয়ে ভাজা এমন ল্যাংচা, সমর্পণ না করে আর উপায় কী!