সিংহ-মার্কা কলের গায়ে জল অপচয় না করার ফরমান সেঁটেছিল ব্রিটিশরা

কলকাতার রাস্তায় জলের কলের মুখে এক তেজিয়ান সিংহ। কিন্তু এককালের জলে ভেজা সেই সিংহের মুখ আজ প্রায় সব জায়গাতেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। গ্রিকো-রোমান স্থাপত্যের থামের মতো দেখতে কলের শরীর। তাতেই আবার এই সিংহ-র মুখ।

যে সময় এমন সিংহমুখো কল এল কলকাতায় তখন আপামর জনগণ একটাই কথা জানতেন, খাবার জলই হোক বা স্নানের জল তার সবেরই উৎস পবিত্র গঙ্গা। সেকালে ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠ ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল পাঠাতেন বিভিন্ন রাজবাড়িতে। যা দিয়ে সেই সব বাড়ির পূজা-আচার সম্পন্ন হত। কলকাতার বাড়িতে বাড়িতে তখন রাখা হত গঙ্গাজলের ঢাউস কলসি। তা ভরে দিয়ে যেত উড়ে জল-বাহকরা। বলতে গেলে গঙ্গাকে ঘিরেই সেদিন গড়ে উঠেছিল ধর্মপ্রাণ মানুষের দিন যাপনের এক অন্যরকম পথের পাঁচালি। এমন কী, কোনো মানুষ দেহত্যাগ করার পূর্ব মূহুর্তেও তাকে রেখে আসা হত গঙ্গার পাড়ে। লোকে বলত, গঙ্গাজলি।

এমনই এক সময়ে, ১৮৭০-এর মে মাসের কিছু পরে দেখা গেল কলকাতার রাস্তায় সিংহমার্কা জলের কল বসল। লোকে অবাক। কারণ এক অদ্ভুত রহস্যময় কলের চাকায় সিংহের মুখ বেয়ে গঙ্গা এসে পড়েছে ঘরের দুয়ারে। ঘরের দুয়ারে গঙ্গাজল পেয়ে লোকে যখন উচ্ছ্বসিত, তখনই হঠাৎ শহরে রটে গেল এমন কলের যে ওয়াশার রয়েছে তা তৈরি করতে নাকি গো-চর্ম লাগে। 'জাত গেল জাত গেল' রব উঠল চারিদিকে। ওদিকে ইসলামি পাড়াতেও রব উঠল ওয়াশারের চামড়া শুকরের। সাহেবরা বুঝলেন, এবার বুঝি ফের সিপাই বিদ্রোহের মত গণবিদ্রোহ ঘটে। সেই অনুসারে কলের জল সম্বন্ধে বোঝানোর ব্যবস্থা পাকা করা হল।

ইংরেজ বাহাদুর সেদিন বুঝতে পেরেছিল, ট্যাঙ্ক তৈরি করে, ঘড়ি ধরে যেভাবে শহরের কোণে কোণে জলের জোগান দেওয়া হয়-- তার মূল্য এদেশের মানুষ ঠিক বুঝতে পারছে না। তাঁদের মতে, যে দেশে গঙ্গা আছে সেই দেশে আবার জলের অভাব কী! আসলে সেদিন কাঠ-কয়লা ও বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যের ভিতর দিয়ে সিংহের মুখে যে জল সরবরাহ করা হয়েছিল, তা যে আসলে পরিশোধিত জল সে কথা বুঝতে পারেনি এদেশের মানুষ। এ দেশে যে গঙ্গায় মরদেহ ভাসে কিংবা ডুবে যায় সেই গঙ্গার জলেই স্নান করে লোকে, সেই জল পানও করে। তাই শহরের কোণে কোণে পরিশোধিত জলের একটা ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন ইংরেজ বাহাদুর।

এই ঘটনার পরিপেক্ষিতেই ১৮৭০-এর পর থেকে যে সব কল এদেশে বসানো হল, তার গায়ে সরাসরি লিখে দেওয়া হল জল অপচয় না করার সতর্কবাণী। আর সিংহের মুখ লাগানো কলে ফরমান লিখে বুঝিয়ে দেওয়া হল, এমন পরিষেবা প্রজা অনুগত-প্রাণ রাজা তাঁর প্রজাদের দিচ্ছেন। তাই অমন জলের অপচয় কাম্য নয়। তাই আজও কোনো কোনো কলের গায়ে আবছা হয়ে যাওয়া ফরমানের মধ্যে থেকে ‘Waste Not’ শব্দটি পড়ে নেওয়া যায়। জল অপচয় না করার প্রথম যুগের দিশা এই কল আজ ইতিহাসেই অবহেলিত।
আজ স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে-- পড়ুক না ফের সিংহের মুখ দিয়ে জল।