ইংরেজরাও ভয় পেত বাংলার প্রথম কিংবদন্তি ফুটবল কোচকে

১৮৮৪ সাল। ইস্টবেঙ্গল-মহামেডানের জন্মই হয়নি। সাদা চামড়াঘেরা ক্লাবগুলির মাঝে একটুকরো ‘নেটিভ মুক্তাঞ্চল’ মোহনবাগান। সেই ক্লাব ছেড়েই বেরিয়ে এসেছিলেন একজন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘এরিয়ান্স ফুটবল ক্লাব’। ময়দানের আনাচে কানাচে কিংবদন্তি এই ‘স্পটার-কোচে’র নামটা এখনো শোনা যায়। স্যার উমেশচন্দ্র অথবা দুঃখিরাম মজুমদার।
মোহনবাগানের মতো মূলধন নেই। ভালো মাঠ নেই। থাকার মধ্যে আছে, নিরন্তর জেদ আর অধ্যাবসায়। আর ‘প্লেয়ার তৈরি’ করার ‘অলৌকিক’ ক্ষমতা। এককলীন মাঠ কাঁপানো ‘সেন্টার হাফ’ দুখিরামের চোখকে ভয় করত ব্রিটিশরা। গলিঘুঁজি, পাড়ার রাস্তা থেকে কচি প্রতিভা খুঁজে বের করেন। কঠোর অনুশীলনে তারাই কাঁচা হিরে, কোহিনুর হয়ে ওঠে। স্টামিনা, দম, ড্রিবলিং পাসিং সব বিষয়ে তাদের পারদর্শী করে তোলেন দুঃখিরাম। যেন মা-পাখির ডানার তলায় বড়ো হয় ছানারা। তারপর, ওই ছেঁড়াখোঁড়া টেন্ট ছেড়ে উড়ে চলে যায় মোহনবাগান কিংবা ডালহাউসিতে।
সূর্য চক্রবর্তী, হাবলা ভট্টাচার্য, পূর্ণ দাস, প্রকাশ ঘোষ-- একের পর এক জাঁদরেল ফুটবলারদের নিজের হাতে গড়েছিলেন তিনি। এরিয়ান্স থেকেই প্রথম প্রথম গড়ের মাঠের ঘাস চিনেছেন অনেকে। তাঁর তৈরি একাডেমিতে প্র্যাকটিস করে গিয়েছেন অন্য ক্লাবের ফুটবলাররাও। এই ব্যাপারে দুঃখিরামের কোনো সংকীর্ণতা ছিল না। তাঁর দর্শন সহজ, শিখতে যারা আসবে, তাদের ফেরাতে পারবেন না তিনি।
মহামেডান আর রেলওয়েজের হয়ে ময়দানের ঘাসে চোখধাঁধানো খেলা খেলছে পূর্ণিয়ার এক ‘বিহারি ছোকরা’। কিন্তু আরো পালিশ প্রয়োজন, ট্রেনিং-এর দরকার। সাত-সকালে সে হাজিরা দিল দুঃখিরাম স্যারের একাডেমিতে। নাম জানতে চাওয়ায় ছোকরা বলে বসে, ‘সৈয়দ আব্দুস সামাদ’। ময়দানের বাইরে তখন প্রবল জাতপাতের রেষারেষি। ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত এলাকায় একজন মুসলমানকে কে আর ঘর ভাড়া দেবে ! কিন্তু ছেলেটা একাডেমির কাছেই ঘর পেল। নাম ভাঁড়িয়ে। ব্যবস্থা করে দিলেন ‘স্যার’। এরিয়ান্সের হয়ে জীবনে খেলেননি ‘ফুটবলের জাদুকর’ সামাদ। কিন্তু গুরু বলতে তিনি একজনকেই মেনে এসেছেন আজীবন...
দুঃখিরামের ট্রেনিং ছিল ভয়ঙ্কর। কলকাতা মাঠ তখন মোটে ‘মখমলে’ ছিল না। আর ফাউল সংক্রান্ত নিয়ম কানুন খুবই অল্প। ফলে, ফুটবলারদের প্রাণটি হাতে করে মাঠে নামতে হত। শোনা যায়, আপন ভাইপো সন্তোষ মজুমদারকে খাটের পায়ের সঙ্গে বেঁধে, বুট পরে লাথি চালাতেন কোচ। সন্তোষ ওরফে ‘ছোনে’ পরে বিখ্যাত ফুটবলার হন, সমস্ত পজিশনে সমান দক্ষতায় খেলতে পারার সুবাদে।
আরো পড়ুন
অতীতচারিতায় মোহনবাগান
সন্তানের মতো স্নেহ করতেন ছাত্রদের। হরিদাস নামক এক খেলোয়াড় যক্ষা রোগে আক্রান্ত। গল্প আছে, প্রতিদিন সাইকেলে পনেরো কিলোমিটার পাড়ি দিতেন তিনি। পরিশ্রুত জল নিয়ে। অসুস্থ প্লেয়ারকে বাঁচানোর জন্য।
স্বল্প পুঁজি নিয়েও ধীরে ধীরে এরিয়ান্স টক্কর দিতে আরম্ভ করল বড়ো বড়ো ক্লাবগুলোর সঙ্গে। সেমিফাইনাল, কোয়ার্টারে উঠতে লাগল। তখন প্রমাদ গুনছে মোহনবাগান। ইতিমধ্যেই ‘ফুটবল স্পটার’ নিয়োগ শুরু করেছে সাহেবরা। মোহনবাগান চর লাগালো দুঃখিরামের পেছনে। উদ্দেশ্য, ওঁর হাত থেকে প্লেয়ার ভাগিয়ে নিয়ে আসা।
এই সংক্রান্ত মজার একটা গপ্প এখনো ময়দানের তাঁবুতে শোনা যায়। একদিন কোনো এক পাড়ার মাঠে ফুটবলার মাপছিলেন দুঃখিরাম। পছন্দও হয়েছে একজনকে। হঠাৎ খেয়াল করলেন, পেছনে মোহনবাগানের চর। চরবাবাজি বিগলিত হেসে শুধোয়, “কেমন দেখলেন ?” আপাত হতাশ দুঃখিরাম বললেন, “ধুর ধুর ! এ-ছেলে সাতজন্ম তপস্যা করেও ফুটবলার হতে পারবে না।” তারপর লোকটা উধাও হতেই, তড়িঘড়ি ছেলেটিকে নিয়ে আসেন একাডেমিতে।
বিদেশে ‘হোম-একাডেমি’ জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্রবাদপ্রতিম জোহান ক্রুয়েফের হাত ধরে। বার্সেলোনার ‘লা মাসিয়া’ কিংবা ওলন্দাজ আয়াক্স একাডেমির নাম যেকোনো ফুটবলপ্রেমীর ঠোঁটস্থ। ‘লা-মাসিয়ার’ ইস্কুল থেকেই উঠে এসেছেন জাভি-ইনিয়েস্তা মায় লিওনেল মেসি। কিন্তু কলকাতা মাঠের এই কিংবদন্তি ফুটবল শিক্ষক হারিয়ে গিয়েছেন স্মৃতির আড়ালে। দুঃখিরাম একাধারে ছিলেন জহুরি, কারিগর ও দক্ষ রণকুশলী। তাঁরই হাতে গড়া ক্লাব এরিয়ান্স পরে মোহনবাগানকে ৪-১ গোলে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড ঘরে তুলেছিল। তখন মালা জড়ানো ধুলো-ধূসরিত ছবির ফাঁক দিয়ে হয়তো মুচকি হাসছিলেন ‘ফুটবল-স্যার’। ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেছে ছেলেরা, এটা কি কম বড় ব্যাপার !